০৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১,
`
মরক্কোয় ভূমিকম্প

‘এক সেকেন্ডকেই যেন একটা মিনিট বলে মনে হচ্ছিল’

আতঙ্কে অনেক মানুষ এখনো রাস্তায় - ছবি : সংগৃহীত

মধ্য মরক্কোয় শুক্রবার রাতে যে ৬.৮ মাত্রার ভূমিকম্প আঘাত হানে, ওই এলাকাতে এত শক্তিশালী ভূমিকম্প ১৯০০ সালের পর আর দেখা যায় নি।

ইতোমধ্যে এতে মৃতের সংখ্যা দুই হাজার ছাড়িয়েছে। আহত হয়েছে আরো প্রায় দুই হাজার মানুষ। দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানান, এদের মধ্যে এক হাজার ৪০০ এর বেশি মানুষ মারাত্মকভাবে আহত।

যারা শারীরিকভাবে আহত হয়নি, তারা এখনো ভয়ঙ্কর মানসিক আঘাতের মধ্যে আছে।

দেশটির সরকারি বার্তা সংস্থা এমএপি জানিয়েছে, দেশটিতে তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক ঘোষণা করেছে সরকার।

ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে জানিয়েছে, ভূমিকম্পটির উৎপত্তিস্থল ছিল মারাকেশ শহর থেকে ৭১ কিলোমিটার দক্ষিণ-পশ্চিমে এটলাস পর্বতমালা এলাকার ১৮ দশমিক পাঁচ কিলোমিটার গভীরে।

ইউরোপ ও আফ্রিকা মহাদেশের নিচে থাকা দুই টেকটোনিকে প্লেটের সঙ্ঘর্ষে থেকেই এ ভূমিকম্পের উৎপত্তি।

মনে করা হচ্ছে, ওই অঞ্চলের ভূ-অভ্যন্তরে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের ফলে অ্যাটলাস পাহাড়ে যে ধাক্কা লাগছে তার সাথে এ ভূমিকম্পের সম্পর্ক আছে।

কিন্তু মরক্কো আসলে এমন শক্তিশালী ভূকম্পন হওয়ার জায়গা নয়।

ওই অঞ্চল অত্যন্ত ধীরগতির (বছরে চার মিলিমিটার)। ভূতাত্ত্বিক ভাষায় এই ‘গাড়ি দুর্ঘটনার’ এলাকা থেকে বেশিরভাগ ভূমিকম্প প্রবণ এলাকাগুলো হলো ভূমধ্যসাগরের আরো পূর্বে ইতালি, গ্রিস থেকে তুরস্কের দিকে।

ইতিহাস বলছে, শুক্রবার রাতে ভূমিকম্পের কেন্দ্র ছিল যে এলাকা, তার আশপাশে ৫০০ কিলোমিটারের মধ্যে ১৯০০ সালের পর কখনোই ছয় মাত্রার উপরে ভূমিকম্প দেখা যায়নি।

তাই এই অভিজ্ঞতার সাথে অপরিচিত থাকার একটা প্রভাব তো পড়েছেই। এখানকার অধিবাসীদের মধ্যে খুব কম সংখ্যকেরই ভূমিকম্পের কোনো স্মৃতি আছে, ফলে তেমন প্রস্তুতিও থাকার কথা না।

এছাড়া বেশিরভাগ ভূমিকম্প, যেগুলো রাতে আঘাত হানে, দেখা যায় সেগুলোতে মৃতের সংখ্যা অনেক বেশি থাকে। কারণ মানুষ সাধারণত এই সময়টায় ধ্বসে পড়া ভবনের ভেতরে অবস্থান করে।

ইউএস জিওলজিক্যাল সার্ভে তাদের মডেল দিয়ে অনুমান করে এ ধরনের দুর্যোগে কী পরিমাণ হতাহত ও অর্থনৈতিক ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। আর তাদের মডেল বলছে মৃতের সংখ্যা অন্তত পাঁচ হাজারে গিয়ে ঠেকতে পারে।

ফলে মরক্কোয় ভূমিকম্পের পর বর্তমান হতাহতের সংখ্যা আরো বাড়তে পারে এবং ভূমিকম্পের দ্বিতীয় ধাক্কার সম্ভাবনাও আছে। হিসাব অনুযায়ী ধারণা করা হয় দ্বিতীয় ধাক্কা প্রধান ভূমিকম্পের চেয়ে এক মাত্রা কম শক্তিশালী হয়ে থাকে।

কিন্তু এর চেয়েও ছোট কম্পনে ইতোমধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত ভবনগুলো ভেঙে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে।

ক্ষয়ক্ষতিটা সবচেয়ে মারাত্মক হয়েছে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ মেদিনার বিভিন্ন অংশে।

এছাড়া পর্যটকদের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ ঐতিহাসিক কুতুবিয়া মসজিদের মিনারও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

এছাড়া আরো বেশ কিছু শহর ভূমিকম্পের ক্ষয়ক্ষতির শিকার। তবে অনেক দূরের যে অঞ্চল বিশেষ করে পাহাড়ি গ্রামের দিকে ক্ষয়ক্ষতিটা এখনো পরিষ্কার হওয়া যাচ্ছে না।

মারাকেশের বাসিন্দা মিনা মেতিওই বলেছেন, ভূমিকম্পের শব্দ ছিল ফাইটার জেটের মতো।

তিনি বলেছেন, ‘এক সেকেন্ডকেই যেন একটা মিনিট বলে মনে হচ্ছিল। এরপর মানুষের চিৎকার, সবাই বাড়ি ঘর ছেড়ে বের হয়ে আসতে থাকে, খুবই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা ছিল।’

জাতিসঙ্ঘ বলছে, ভূমিকম্পে মারাক্কেশের অন্তত তিন লাখ লোক ক্ষতির শিকার হয়েছে।

সংস্থাটি মরক্কো সরকারের সাথে মিলে উদ্ধার সহায়তা করার কথা জানিয়েছে।

উদ্ধারকাজ এখনো চলমান, কিন্তু ধ্বংসস্তুপের ভেতরে উদ্ধার কাজ চালাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছে উদ্ধারকর্মীরা।

কর্তৃপক্ষ সবাইকে রক্তদানের আহ্বান জানিয়েছে। তাতে এগিয়ে এসেছে জাতীয় দলের ফুটবলাররাও।

আশরাফ হাকিমিও যোগাযোগমাধ্যমে তার এক্স অ্যাকাউন্টে (সাবেক টুইটার) রক্তদানের ছবি পোস্ট করে লিখেছেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে এখন রক্তদান সবচেয়ে জরুরি। সবার দায়িত্ব রক্তদানে এগিয়ে এসে যত সম্ভব জীবন বাঁচানো। আপনার সাহায্য দরকার।’

সামাজিক মাধ্যমগুলোতে ক্ষতিগ্রস্ত ভবন ও রাস্তায় ধ্বংসস্তূপের ভিডিও দেখা যাচ্ছে।

ভূমিকম্পের আতঙ্কে এখনো অসংখ্য মানুষ রাস্তায় থাকছে। কিছু কিছু শহরে মৃদু ভূমিকম্পের খবরও পাওয়া যাচ্ছে।

সর্বশেষ ২০০৪ সালে দেশটির উত্তর-পূর্বের আল হোসেইমা অঞ্চলে ভূমিকম্পে ৬২৮ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

কিন্তু এবারে ভূমিকম্পের যে কেন্দ্রস্থল অ্যাটলাস পর্বতমালার দিকে, ওই অঞ্চলে এমন অনেক দুর্গম গ্রাম রয়েছে যেখানে পৌঁছানো যথেষ্ট কষ্টসাধ্য।

কাজেই এই ভূমিকম্পের আসল ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কী, তা নিশ্চিতভাবে জানতে বেশ কয়েক দিন লেগে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

ভৌগলিক অবস্থানের হিসেবে মরক্কো আফ্রিকা আর ইউরোপের মধ্যে রয়েছে। আফ্রিকা ও আরব বিশ্বের ওপর এই দেশটির প্রভাব রয়েছে। আটলান্টিক মহাসাগর ও ভূমধ্যসাগরের উপকূল রয়েছে এই দেশটির সাথে। দেশটির মধ্যে রুক্ষ পাহাড়ও রয়েছে।

দেশটির মোট জনসংখ্যা প্রায় তিন কোটি ৪০ রাখ এবং আয়তন প্রায় সাড়ে চার লাখ বর্গ কিলোমিটার। দেশটির সংস্কৃতিতে আরব, বেরবার, ইউরোপিয় ও আফ্রিকান প্রভাব রয়েছে।
সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement