২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

তিউনিসিয়ায় বিক্ষোভ ও অভ্যুত্থান : ঘটনাপ্রবাহ ও চলমান পরিস্থিতি

তিউনিসে পার্লামেন্টের সামনে প্রেসিডেন্টের আদেশের প্রতিবাদে বিক্ষোভ - ছবি : আলজাজিরা/ আনাদোলু এজেন্সি

এক দশক আগে আরব বসন্তের প্রভাবে আরব দেশগুলোর নাগরিকরা নিজেদের দেশের স্বৈরশাসকদের বিরুদ্ধে রাস্তায় নেমে এসেছিল। মরক্কো থেকে ইরাকজুড়ে স্বৈরশাসকবিরোধী এই বিক্ষোভের একমাত্র সফল পরিণতি ছিল উত্তর আফ্রিকার দেশ তিউনিসিয়ায়।

কিন্তু রোববার দেশটিতে আকস্মিক সরকারবিরোধী বিক্ষোভের পর প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইদ রাতে দুই বছর আগে নির্বাচিত পার্লামেন্ট স্থগিত, প্রধানমন্ত্রী হিশাম মাশিশিকে বরখাস্ত ও নিজের হাতে নির্বাহী ক্ষমতা নেয়ার ঘোষণা দিয়ে আদেশ জারি করেন।

যদিও প্রেসিডেন্টের সমর্থকরা মনে করছেন, দেশের সংকটাপন্ন অবস্থায় স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় এটি বলিষ্ঠ সিদ্ধান্ত। অপরদিকে বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আননাহদাসহ সব রাজনৈতিক দলই প্রেসিডেন্টের আদেশকে ‘সাংবিধানিক অভ্যুত্থান’ হিসেবে মন্তব্য করেছে।

তিউনিসিয়ার দীর্ঘকালীন স্বৈরশাসক জায়নুল আবেদিন বিন আলী ২০১১ সালে আরব বসন্তে বিক্ষোভে ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর বিক্ষোভকারীদের দাবি পূরণে পরবর্তী সরকারগুলো সংগ্রাম চালায়। দারিদ্র ও বেকারত্বে জর্জরিত এই বিক্ষোভকারীদের আকাঙ্ক্ষা ছিল দেশটিতে অবাধ নির্বাচন ও নাগরিক স্বাধীনতার প্রতিষ্ঠা।

বিপ্লবের পরেও তিউনিসিয়ায় বিশেষ করে যুব সমাজের মধ্যে বেকারত্বের সমস্যা অব্যাহত থাকে। পাশাপাশি উগ্রবাদী আইএসের কয়েক দফা হামলার ঘটনায় দেশটির আয়ের প্রধান উৎস পর্যটনেও ভাটা পড়ে। জীবন ধারণের মান ও সরকারি পরিষেবাও কমে আসে।

২০১৯ সালের অক্টোবরে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর নিজেকে রাজনৈতিকবিরোধী হিসেবে প্রচারের প্রয়াস নেন কায়েস সাইদ। রাজনৈতিক দলবিহীন স্বতন্ত্রভাবে নির্বাচিত সাবেক এই আইনের অধ্যাপক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে দুর্নীতি দমনের প্রতিজ্ঞা করেন।

দায়িত্ব নেয়ার অল্প কয়েক মাস পরেই তিউনিসিয়ায় করোনাভাইরাস সংক্রমণ শুরু হয়। এক কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার দেশে ভাইরাস সংক্রমণে ১৭ হাজারের বেশি লোকের প্রাণহানি হয়। করোনা পরিস্থিতি বিপ্লবের পর খুঁড়িয়ে চলা দেশটির স্বাস্থ্যখাতের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং অর্থনৈতিক সংকটকে আরো জটিল করে।

মে মাসে তিউনিসিয়া আন্তর্জাতিক তহবিল সংস্থা আইএমএফের সাথে আর্থিক সাহায্য প্যাকেজের বিষয়ে আলোচনা শুরু করে। যদি তা গ্রহণ করা হয়, তবে তা সংস্থাটি থেকে দেশটির জন্য চতুর্থবারের ঋণ নেয়া হবে।

তিউনিসিয়ার ঋণগ্রহণের বিনিময়ে আইএমএফের চাহিদা অনুযায়ী ইতোমধ্যেই দেশটিতে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ানো হয়েছে। একইসাথে করের হার বাড়ানো ও সরকারি ক্ষেত্রে চাকরির পরিমাণ কমানো হয়েছে। এর ফলে বিন আলীর সময় থেকেই নিষ্পেষিত জনগণ আরো ক্ষুব্ধ হয়।

এই বছর দেশের অর্থনীতি ছয় দশমিক পাঁচ ভাগ অবনতির আশঙ্কার মধ্যেই তিউনিসিয়ার জনগণের একাংশ রাজনৈতিক দলগুলোর বিপক্ষে বিক্ষোভ শুরু করে যাদের তারা শাসনের অযোগ্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত হিসেবে মনে করছে।

গত মে মাসে প্রোসিডেন্ট কায়েস সাইদের চিফ অব স্টাফ নাদিয়া আকাশার দফতর থেকে এক গোপন দলিল প্রকাশ হয়ে পড়ে। এই দলিলে দেশের বিপুল সমস্যা সমাধানে ‘সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব করা হয়।

দলিলে বলা হয়, ‘জাতীয় জরুরি অবস্থা’ মোকবেলায় রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সব ক্ষমতা তার হাতে নেবেন।

রোববার তিউনিসের রাস্তায় সরকারবিরোধী বিক্ষোভের পর সাইদ পার্লামেন্ট স্থগিত করার আদেশ দেন। পরে তিনি জানান, ৩০ দিনের জন্য এই স্থগিতাদেশ কার্যকর থাকবে।

প্রেসিডেন্ট তার বিবৃতিতে বলেন, ‘সংবিধান পার্লামেন্ট ভেঙে দেয়ার অনুমোদন দেয় না তবে এতে স্থগিতাদেশের অনুমোদন রয়েছে।’

বিবৃতিতে বলা হয়, তিউনিসিয়ার সংবিধানের ৮০ ধারা অনুসারে ‘অনিবার্য বিপদের’ মুখে প্রেসিডেন্টের পার্লামেন্টের কাজে স্থগিতাদেশের অনুমোদন রয়েছে।

এতে তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী হিশাম মাশিশিকে তিনি বরখাস্ত করেছেন এবং নির্বাহী ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়েছেন। পাশাপাশি পার্লামেন্ট সদস্যদের বিচার থেকে অব্যাহতির সুবিধাও তুলে নেয়ার ঘোষণা দেন তিনি।

পরে আরেক বিবৃতিতে দেশটির প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও আইনমন্ত্রীকে অপসারনের কথা জানান কায়েস সাইদ।

প্রেসিডেন্টের ঘোষণার পর রাজধানী তিউনিসের সব সরকারি ভবনের পাহারায় সামরিক বাহিনী মোতায়েন করা হয়।

পরে অপর এক আদেশের মাধ্যমে তিউনিসিয়ায় সোমবার থেকে ২৭ আগস্ট পর্যন্ত রাত্রিকালীন কারফিউ জারি করেন সাইদ। কারফিউর আদেশ অনুসারে জরুরি প্রয়োজন ছাড়া সন্ধ্যা ৭টা থেকে ভোর ৬টা পর্যন্ত চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়। একই আদেশে সরকারি সড়ক ও চত্ত্বরে তিনজনের বেশি সমাগমে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়।

অপরদিকে সোমবার কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আলজাজিরার তিউনিস কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে পুলিশ কার্যালয় থেকে সব কর্মীদের বের করে দিয়ে তা বন্ধ করে দেয়।

সরকারবিরোধী বিক্ষোভকারীরা প্রাথমিকভাবে সাইদের ঘোষণাকে স্বাগত জানায়। পার্লামেন্ট স্থগিতের ঘোষণায় তারা উল্লাস প্রকাশ করে এবং পার্লামেন্ট ও বৃহত্তম রাজনৈতিক দল আননাহদার বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়।

অপরদিকে প্রেসিডেন্টের ঘোষণায় ইসলামপন্থী আননাহদার সমর্থকরা অসন্তোষ জানায়। দলটির প্রধান ও তিউনিসিয়ার পার্লামেন্টের স্পিকার রশিদ গানুশি প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্তকে ‘অভ্যুত্থান’ হিসেবে উল্লেখ করেন।

অন্যান্য রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দ এই ঘোষণাকে প্রত্যাখ্যান করে।

বিপ্লব পরবর্তী তিউনিসিয়ায় প্রথম প্রেসিডেন্ট মুসসেফ মারজুকি ফেসবুকে এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘যদি এই অভ্যুত্থান সফল হয়, তবে দেশের অর্থনীতি ও স্বাস্থ্যক্ষেত্রের অবস্থা ধসে পরবে।’

তিনি বলেন, ‘সাইদ যে সংবিধান অনুসারে শপথ নিয়েছিলেন, তা লঙ্ঘন করেছেন এবং সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়েছেন। নিজেকে নির্বাহী ক্ষমতার প্রধান ও প্রথম বিচারক হিসেবে বিবেচনা করছেন সাইদ।’

অপরদিকে দ্বিতীয় বৃহত্তম দল ধর্মনিরপেক্ষবাদী কালব তিউনিস জানায়, প্রেসিডেন্ট সংবিধান লঙ্ঘন করেছেন। মার্কস ও লেনিনবাদী ওয়ার্কার্স পার্টি ‘অভ্যুত্থান’ বলে এই পদক্ষেপকে প্রত্যাখ্যান করে জানিয়েছে, এর মাধ্যমে তিউনিসিয়া আবার স্বৈরশাসনের কবলে পড়তে যাচ্ছে।

শুধু নাসেরবাদী হরকত আল-শাব প্রেসিডেন্ট কায়েস সাইদের এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছে। দলটি প্রেসিডেন্টের এই পদক্ষেপকে ‘বিপ্লবের পথে সংশোধন’ হিসেবে উল্লেখ করে।

অন্যদিকে তিউনিসিয়ার ১০ লাখ সদস্যের প্রভাবশালী শ্রমিক সংগঠন জেনারেল লেবার ইউনিয়ন সাইদের পদক্ষেপকে প্রত্যাখ্যান না করার কথা জানিয়ে বলছে, এই পর্যায়ে প্রতিটি কাজ সাংবিধানিক বৈধতা মেনে করা প্রয়োজন।

কায়েস সাইদের ঘোষণার জেরে সোমবার রাজধানী তিউনিসে পার্লামেন্টের সামনে আননাহদাসহ প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীরা বিক্ষোভ সমাবেশ করে। অপরদিকে কায়েস সাইদের সমর্থকরাও পার্লামেন্টের সামনে জড়ো হয়। দুই পক্ষের মধ্যেই বিক্ষোভের এক পর্যায়ে পরস্পরের প্রতি পাথর. বোতল ও ডিম নিক্ষেপের ঘটনা ঘটে।

তিউনিসিয়ার পরিস্থিতিতে বিভিন্ন রাষ্ট্রই দেশটিতে গণতন্ত্রের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে। যদিও বেশিরভাগই একে ‘অভ্যুত্থান’ হিসেবে উল্লেখ করা থেকে বিরত থাকে।

তুরস্কের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তিউনিসিয়ার পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ জানায় এবং যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশটিতে ‘গণতান্ত্রিক বৈধতা’ প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানায়।

অপরদিকে জার্মান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তিউনিসিয়ায় সাংবিধানিক শৃঙ্খলা অনতিবিলম্বে প্রতিষ্ঠার আহ্বান জানানো হয়।

যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজের মুখপাত্র এক সংবাদ সম্মেলনে তিউনিসিয়ার পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ জানিয়ে বলেন, তারা দেশটির পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছেন।’

কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জানানো হয়, তারা প্রত্যাশা করছে তিউনিসিয়ার দলগুলো সংকট উত্তরণে সংলাপের পথে অগ্রসর হবে।

অবশ্য সংযুক্ত আরব আমিরাত ও সৌদি আরবে এর প্রতিক্রিয়া ছিল ভিন্নরূপ।

আমিরাতের সংবাদমাধ্যম টোয়েন্টি ফোর মিডিয়ায় হেডলাইন করা হয়, ‘তিউনিসিয়াকে রক্ষায় সাহসী সিদ্ধান্ত’। অন্যদিকে অনেক সৌদি ও আমিরাতি একাউন্টে আননাহদার সাথে মুসলিম ব্রাদারহুডের সম্পর্ককে ইঙ্গিত করে হ্যাশট্যাগে ‘ব্রাদারহুডের বিরুদ্ধে তিউনিসিয়ার বিক্ষোভ’ যুক্ত পোস্টের সমাহার দেখা যায়।

সোমবার আলজাজিরার সাথে সাক্ষাতকারে সাবেক প্রেসিডেন্ট মুনসেফ মারজুকি উল্লেখ করেছিলেন, তার কোনো সন্দেহ নেই এই অভ্যুত্থানের পেছনে সংযুক্ত আরব আমিরাতের হাত রয়েছে।

এদিকে লিবিয়ার যুদ্ধবাজ নেতা খলিফা হাফতার তিউনিসিয়ার প্রেসিডেন্ট সাইদের পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়েছেন। সাথে সাথে তিনি জানিয়েছেন, তার বাহিনীকে তিনি আদেশ দিয়ে রেখেছেন তিউনিসিয়ায় বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশটিতে ঢুকে পড়া সন্ত্রাসবাদী যোদ্ধাদের প্রতিহত করতে প্রস্তুত থাকার।

সূত্র : মিডল ইস্ট আই ও আলজাজিরা


আরো সংবাদ



premium cement