২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েও কেন বিসিএস ক্যাডারে যান

ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ারিং পড়েও কেন বিসিএস ক্যাডারে যান - ছবি : সংগৃহীত

দেশে চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হওয়াকে বেশ সম্মানজনক বলে মনে করেন অনেকে। ডাক্তারি বা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়াতে অভিভাবকদের যেমন উৎসাহ থাকে। শিক্ষার্থীরাও আগ্রহ দেখান এসব বিষয়ে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে। কিন্তু ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হলেও তাদের একটি বড় অংশ এখন পেশা হিসেবে বেছে নিচ্ছেন বিসিএস ক্যাডারের বিভিন্ন পদ। এমনকি তাদের মধ্য থেকে পুলিশ, প্রশাসন, পররাষ্ট্র ও কর ক্যাডারে আছেন অনেকে।

কিন্তু কেন?
পেশা হিসেবে প্রশাসনিক ক্যাডার বেছে নেয়ার কারণ হিসেবে তারা মূলত ভালো বেতন ও চাকরির নিশ্চয়তার কথা বলছেন।

ডাক্তার ও ইঞ্জিনিয়ারদের এই পেশা পরিবর্তনের বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘আমাদের মন্ত্রণালয়ে এখন বহু ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার। এবার সদ্য যোগ দেয়া ২৩ জনের মধ্যে ১৪ জনই ইঞ্জিনিয়ার, পাঁচজন ডাক্তার।'

গত শনিবার বুয়েটের এক অনুষ্ঠানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কথা বলেন। তিনি একে রাষ্ট্রের ক্ষতি বলেও উল্লেখ করেন।

ইদানীং চিকিৎসা বা প্রকৌশলবিদ্যার ডিগ্রি নিয়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক শিক্ষার্থী বিসিএস ক্যাডার হচ্ছেন বলেও এক অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন।

চিকিৎসক ও প্রকৌশলীরা যা বলেছেন
মূলত প্রশাসনিক ক্যাডারে চাকরি হলে ধারাবাহিক পদোন্নতি, ড্রাইভারসহ গাড়ি সুবিধা, বাংলো বা সরকারি কোয়ার্টারে থাকা, বিদেশে স্কলারশিপ নিয়ে পড়াশোনা, অবসরের পর পেনশন, ভাতাসহ আরো নানা সুবিধা পাওয়া যায়। এ ছাড়াও আলাদা অফিস কক্ষ, ব্যক্তিগত সহকারী ও সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে সম্মান তো আছেই।

এসব কিছু বিবেচনা করেই পেশাদার চিকিৎসক বা প্রকৌশলী হওয়ার চেয়ে প্রশাসনিক ক্যাডার হওয়াকেই যৌক্তিক সিদ্ধান্ত বলে মনে করছেন শিক্ষার্থীরা।

চাকরির নিশ্চয়তা
৩৮তম বিসিএসে পুলিশ ক্যাডার হিসেবে যোগ দিয়েছেন তারেক লতিফ সামি। অথচ তিনি ছিলেন কুয়েটের কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে শিক্ষার্থী। ছোটবেলা থেকে তিনি একজন প্রকৌশলী হতে চেয়েছেন। তার একবারও বিসিএস পরীক্ষা দেয়ার বিষয়টি মাথায় আসেনি।

পুলিশ কর্মকর্তা সামি বলেন, ‘কম্পিউটার সায়েন্সে পড়া শিক্ষার্থীদের সামনে দুটো পথ থাকে। এক, তারা দেশের প্রাইভেট ফার্মগুলোয় কাজ করতে পারে। না হলে বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য গিয়ে সেখানে সেটেল হতে পারে। আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম দেশেই থাকবো।’

কুয়েট থেকে পাস করার পর তিনি শুরুতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ শুরু করেন। সেখানে কাজ করে তার উপলব্ধি হয় যে, এসব প্রতিষ্ঠানে চাকরির কোনো নিশ্চয়তা নেই।

তার ভাষায়, ‘প্রতিষ্ঠান কখনো লোকসানের মুখে পড়লে ঢালাওভাবে সবার চাকরি যাওয়ার আশঙ্কা থাকে, ছাঁটাই হয়। তা আপনি যতো ভালো কাজ করুন না কেন।’

বেতন, সম্মান ও কাজের পরিবেশ
এতো ঝুঁকি মাথায় নিয়ে কাজ করা সত্ত্বেও তিনি মাস শেষে সামি যে বেতন পেতেন সেটাও যথেষ্ট ছিল না। তার সাথে পড়া অন্যান্য প্রকৌশলীদের অবস্থা ছিল তার চেয়েও শোচনীয়।

‘আইটিতে আগের চাইতে বেতন কিছুটা বেড়েছে। কিন্তু সেটাও সরকারি চাকরির তুলনায় অনেক কম। তবে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং, সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পড়া অনেকেই দেখেছি মাত্র ১৫ হাজার টাকার বেতনে যোগ দিতে। কারণ কোনো চাকরি নেই,’বলছিলেন কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার সামি।

তিনি জানান, এমন বাস্তবতার মুখে পুলিশ ‘ফার্স্ট চয়েস’ দিয়ে ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষায় অংশ নেন। সামি এখন একজন পুলিশ ক্যাডার। তার মতো সব শিক্ষার্থীর আস্থা যে বিসিএস নিয়োগের ক্ষেত্রে কোনো দুর্নীতি হয় না।

বাংলাদেশে আইসিটি ক্যাডার পদে সুযোগ সৃষ্টির কথা বলা হলেও সেটা আজ পর্যন্ত চালু হয়নি। বরং টেলিকমিউনিকেশন ক্যাডার পদে নিয়োগের প্রক্রিয়া ২০০৭ সালেই বন্ধ করে দেয়া হয়। এমন অবস্থায় সামি জেনারেল ক্যাডার বেছে নেন। যেখানে কম্পিউটার প্রকৌশলীর প্রয়োজন আছে।

এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘পুলিশে আইটি ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে এখন কাজ করার অনেক সুযোগ আছে। বিশেষ করে সাইবার ক্রাইমে এই বিশেষজ্ঞদের প্রয়োজন হয়। আমি সেটাই করছি।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, মূলত ২০১৫ সালে সরকারি চাকরির বেতন স্কেল বাড়ানোর পর সরকারি চাকরির প্রতি সবার আগ্রহ বাড়তে থাকে। নবম গ্রেডে চাকরির শুরুতেই একজনের বেসিক বেতন থাকে ২৩ হাজার এক শ’ টাকা। অর্থাৎ মোট বেতন শুরুতেই ৩৫ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকার মতো হয়।

সামি বলেন, ‘এখানে বেতন ভালো, কাজের পরিবেশ অনেক ভালো। প্রাইভেটে কাজ করার সময় একটা ডেস্কে আমরা কয়েকজন বসতাম। এখানে আমার নিজস্ব কক্ষ আছে। অফিস সহকারী আছে।’

এছাড়াও একজন সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে তিনি যে সম্মান পেয়ে থাকেন তা প্রকৌশলী থাকাকালীন ছিল না বলে তিনি উল্লেখ করেন।

স্বাস্থ্য ক্যাডার না হয়ে জেনারেল ক্যাডার
চিকিৎসকদের ক্ষেত্রে বিষয়টি একটু ভিন্ন। এখানে বিসিএস পরীক্ষা দিয়ে কেউ স্বাস্থ্য ক্যাডার হলেও তারা প্রশাসনিক ক্যাডারের অনেক সুবিধাই পান না বলে জানিয়েছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক চিকিৎসক। তিনি জানান, দেশে যেসব মেডিক্যাল শিক্ষার্থী এমবিবিএস ডিগ্রি অর্জন করার পর বিসিএস পরীক্ষা দেন ও সুযোগ পান তাদের নিয়োগ পেতে আরো দুই থেকে তিন বছর চলে যায়। চাকরির শুরুতে তাদেরকে অন্তত দু’বছর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কাজ করতে হয়। সেখানে সরকারি কোয়ার্টারে ভাড়া দিয়ে থাকতে হয়, গাড়ির কোনো সুব্যবস্থা নেই। এ ছাড়াও যে বেতন দেয়া হয় তা দিয়ে চলার মতো যথেষ্ট নয়।

উপজেলায় চিকিৎসকরা নানা ধরনের অপ্রত্যাশিত আচরণের শিকার হয়ে থাকেন বলেও জানান তিনি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এ চিকিৎসকও বর্তমানে একজন পুলিশ ক্যাডার।

এই চিকিৎসকরা পোস্ট গ্রাজুয়েশন অর্থাৎ এমডি, এমএস, এফসিপিএস ইত্যাদি ডিগ্রি সম্পন্ন না করলে তাদের পদোন্নতির কোনো সুযোগ নেই। এই পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিগ্রির জন্য একজন চিকিৎসককে কয়েক বছর একটি মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপকের অধীনে প্রশিক্ষণ নিতে হয়। সেটার পর তিনি ফাইনাল পরীক্ষা দেন। যা শেষ করতে সব মিলিয়ে সাত থেকে ১০ বছর লাগে। এর আগে একজন চিকিৎসক পদোন্নতির আবেদনই করতে পারেন না বলেও জানান ডাক্তারি পড়ে পুলিশ হওয়া ওই কর্মকর্তা।

তিনি জানান, এই পুরো সময় একজন চিকিৎসকের মাসিক ভাতা দেয়া হয় ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকার মতো। যেখানে প্রশাসনিক ক্যাডারে বেতনও ভালো, পদোন্নতির সুযোগও পাওয়া যায় অনেক আগে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা জানান, বাংলাদেশের পোস্ট গ্রাজুয়েশন পদ্ধতি অনেক দীর্ঘমেয়াদী ও ইন্সটিউটগুলোতে আসন সংখ্যা খুবই কম। একটি পদের জন্য অনেক সময় ৫০ জন ডাক্তারকে লড়াই করতে হয়।

ওই একই প্রচেষ্টায় তিনি যদি বিসিএস পরীক্ষা দেন তাহলে তাকে পোস্ট গ্রাজুয়েশনের চিন্তাটা করতে হয় না। তার ক্যারিয়ার গড়ে ওঠে। এটাকেই সবচেয়ে বড় মোটিভেশন বলে তিনি মনে করেন।

তার ভাষায়, ‘১০ থেকে ১৫ বছর আগে বাংলাদেশে ডাক্তারের সংখ্যা অনেক কম ছিল। এখন প্রাইভেট মেডিকেল হয়েছে অনেক। সরকারের নিয়োগ দেয়ার সক্ষমতার চাইতে এখন ডাক্তারের সংখ্যা বেশি। এতে চাকরি পাওয়ার সুযোগ কমে গেছে।’

অবশ্য স্বাস্থ্য অধিদফতরের ২০১৯ সালের হিসাব বলছে, দেশের সব সরকারি হাসপাতালে ২০ শতাংশের বেশি চিকিৎসক পদ খালি রয়েছে। বেসরকারি হিসাবে দেশের জেলা ও উপজেলায় ৬০ শতাংশের বেশি চিকিৎসক পদ খালি। কিন্তু দেশের জনসংখ্যা ও রোগীর সংখ্যা বিবেচনায় কমপক্ষে দু’লাখ চিকিৎসক প্রয়োজন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

তবে চিকিৎসকদের জন্য পোস্ট গ্রাজুয়েশন পরীক্ষাকে সবচেয়ে বড় চাপ বলে মনে করেন ওই সরকারি কর্মকর্তা। তার মতে, বাংলাদেশে পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিগ্রি ছাড়া একজন ডাক্তারের কোনো মূল্য নেই। কারণ, সবাই বিশেষজ্ঞ ডাক্তারই খোঁজেন। কিন্তু এর পেছনে যে সময় লাগে ওই সময়ে অন্য ক্যারিয়ারে এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ বেশি।

তাই পোস্ট গ্রাজুয়েশনের এই দীর্ঘ প্রক্রিয়া এড়িয়ে যেতে ও পদোন্নতি, গাড়ি, বাড়িসহ অন্যান্য সুবিধা পেতে চিকিৎসকরা আজকাল মেডিক্যাল ক্যাডারের পরিবর্তে জেনারেল ক্যাডারে পরীক্ষা দিতেই বেশি আগ্রহী।

রাষ্ট্রের ক্ষতি
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন সূত্র মতে, একজন প্রকৌশলীর স্নাতক ও স্নাতকোত্তর মিলে খরচ হয় তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা। অনেক সময় তার চেয়েও বেশি। এ ছাড়াও সরকারি মেডিক্যাল কলেজগুলোয় প্রত্যেক শিক্ষার্থীর পেছনে ১০ লাখ থেকে ১৫ লাখ টাকা খরচ হয় বলে জানা গেছে।

এ নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেছেন, একজন শিক্ষার্থীকে চিকিৎসক হিসেবে তৈরি করতে রাষ্ট্রের বিপুল অর্থ ব্যয় হয়, ওই চিকিৎসক যখন অন্য পেশায় চলে যান, তখন তা রাষ্ট্রের জন্য বিশাল ক্ষতি।

মন্ত্রী জানান যে বাংলাদেশে একজন প্রকৌশল ও মেডিক্যাল শিক্ষার্থীর পড়াশোনার জন্য সরকারিভাবে যথেষ্ট অনুদান ও ভর্তুকি দেয়া হয়। এ কারণে ওই শিক্ষার্থীদের এই ব্যয়বহুল উচ্চশিক্ষা নিতে নিজের পকেট থেকে খুব একটা পয়সা খরচ করতে হয় না।

তিনি বলেন, ‘ডাক্তাররা পেশা পরিবর্তন করলে আমার দুঃখ লাগে। এত কষ্ট করে ডাক্তারি পাস হয়, যারা মানুষের সেবার জন্য একেবারে সরাসরি হেলপ করেন। তারা পরে অন্য জায়গায় গেলে এটি রাষ্ট্রের ক্ষতি।’

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement