১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রভাবশালীদের দখলে বিএডিসির শত শত কোটি টাকার সম্পত্তি

প্রভাবশালীদের দখলে বিএডিসির শত শত কোটি টাকার সম্পত্তি - ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) শত শত কোটি টাকার সম্পদ বেহাত-বেদখলে। বিএডিসি বলছে বেদখলে থাকা জমির পরিমাণ ৪১.২৯৮৭ একর বা প্রায় ১২৫ বিঘা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এর পরিমাণ আরো বেশি বলে জানা গেছে। এসব জমির কোথাও কোথাও স্থাপনা রয়েছে। স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি এসব জমি ও স্থাপনা ভোগদখল করে আছেন দীর্ঘদিন ধরে। রাজনৈতিক প্রশ্রয় এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের অবহেলা-নির্লিপ্ততার কারণে এসব জমি হাতছাড়া হয়েছে। শত শত কোটি টাকা মূল্যের বিপুল পরিমাণ এই সম্পত্তি উদ্ধারে উদ্যোগ নেয়া হলেও সফলতা খুবই কম। মামলা পাল্টা মামলা বা রিট পিটিশনে আটকে আছে ভূমি উদ্ধার কার্যক্রম। এই জমি দখলদারদের মধ্যে ব্যক্তির সংখ্যাই বেশি। তবে এসব জায়গায় কিছু প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলা হয়েছে।

বিএডিসি সূত্রে জানা যায়, কৃষি মন্ত্রণালয়ের এই সংস্থাটির ঢাকাসহ সারা দেশে মোট জমি রয়েছে ৯ হাজার ৬৫৫.০০৪ একর বা প্রায় ২৮ হাজার ৯৬৫ বিঘা। এই সম্পত্তির মধ্যে বিএডিসির বীজ উদ্যান বিভাগের রয়েছে ৬ হাজার ৬০০.৮৩ একর বা ১৯ হাজার ৮০৩ বিঘা, সার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ৩৭০.৬৫৬৩ একর বা ১ হাজার ১১৩ বিঘা, ক্ষুদ্র সেচ বিভাগের ২১৩.৯৪৬১ একর বা প্রায় ৬৪২ বিঘা, প্রশাসন বিভাগের ৭.১৪ একর বা প্রায় সাড়ে ২১ বিঘা। এর মধ্যে ৪১.২৯৮৭ একর বা প্রায় ১২৫ বিঘা জমি বেদখলে রয়েছে। তবে এর বাইরে আরো অনেক জমি রয়েছে, যেগুলো বিএডিসির হলেও অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে রেকর্ড হয়েছে।

সবচেয়ে বড় বা বেশি জমি বেহাত রয়েছে দিনাজপুরের পার্বতীপুরে। পার্বতীপুর রেল স্টেশন সংলগ্ন প্রায় ১৩.৬০ একর বা ৪১ বিঘা জমি বেদখলে রয়েছে। যেটির এখন হাইকোর্টে রিট পিটিশন মামলা চলমান। জমিটি মূলত বিএডিসির পাট বীজ উইংয়ের আওতায়। পাটবীজ বিভাগের মহাব্যবস্থাপক মো: মোস্তাফিজুর রহমান নয়া দিগন্তকে বলেন, এই জমি কেউ এখন ভোগ দখল করে না। খাজনা আমরাই দিয়ে আসছি। আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করা আছে। এ ব্যাপারে পাটবীজ বিভাগের যুগ্ম পরিচালক (দিনাজপুর জেলা) মো: শহীদুল ইসলাম বলেন, এই জমির মালিকানা ছিল সার বিভাগের। নব্বইয়ের দশকে সার বিভাগ উঠে যায়। পরে কিছু লোক এটা দখল করে। ২০০৬ সালে আমাদের (বিএডিসি) লোকজন নড়েচড়ে বসে, তখন সার বিভাগের বাজেট ছিল না। তখন পাটবীজ বিভাগকে এই জমি হস্তান্তর করা হয়। কাগজপত্র সংগ্রহ করে পাটবীজ বিভাগ এই জমি উদ্ধারে আইন বিভাগকে দায়িত্ব দেয়। তবে কে বা কারা এই জমি দখল করেছে তা তিনি জানেন না বলে উল্লেখ করেন।

গত ২৬ জানুয়ারি কৃষি মন্ত্রণালয় এবং অধিনস্থ দফতর/সংস্থার সরকারি সম্পত্তি উদ্ধার সংক্রান্ত টাস্কফোর্সের ৬৬তম সভা অনুষ্ঠিত হয়। কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (প্রশাসন) ড. মো: আবদুর রৌফের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় দফতর/সংস্থার প্রধানরা উপস্থিত ছিলেন। কার্যবিবরণীতে বিএডিসির বেহাত হওয়া বেশ কিছু জমি নিয়ে আলোচনা হয়। এর মধ্যে সাভারের টাট্টি মৌজার ৩৩ শতক জমির মালিকানা সংক্রান্ত বিরোধ দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য বিএডিসির চেয়ারম্যানকে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলা হয়। ১৯৯৫ সাল থেকে এই জমি বিএডিসির বেদখলে রয়েছে। এই জমির দখলদার ইউসুফ আহমেদ মারা গেছেন। তবে তার উত্তরাধিকারীরা সেখানে বহুতল স্থায়ী মার্কেট (চৌরঙ্গী সুপার মার্কেট) নির্মাণ করে ব্যবসা করছেন বলে বিএডিসির আরেক সভার কার্যবিরণী থেকে জানা যায়। ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর অনুষ্ঠিত বিএডিসির মালিকানাধীন বেহাত/বেদখল ভূমি ও স্থাপনা পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত ২৫তম সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, ঢাকার গাবতলীস্থ মিরপুর ও নন্দারবাগ মৌজার মোট ১১৭.০৮ একর জমির মধ্যে ১৫.৯৭ একর জমি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে রেকর্ড হয়েছে। কিছু ব্যক্তি ১.৫০ একর জমি সিটি জরিপে রেকর্ড করে নিয়েছে। বিএডিসির নামে রেকর্ড না হওয়া জমির রেকর্ড সংশোধনের নিমিত্ত জেলা প্রশাসকের নির্দেশনা মোতাবেক দেওয়ানি মামলা দায়ের, সীমানা নির্ধারণ ও অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়।

তবে সর্বশেষ দফতর/সংস্থার সরকারি সম্পত্তি উদ্ধার সংক্রান্ত কৃষি মন্ত্রণালয়ের গত ২৬ জানুয়ারির সভার কার্যবিরণীতে বলা হয়, বিএডিসির মিরপুরস্থ বীজ উৎপাদন খামারের ২.২৫ একর জমি গাবতলী আন্তঃজেলা বাস টার্মিনালের দখলে রয়েছে। জমিটি ফেরত প্রদানের জন্য ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনকে চিঠি দেয়া হয়েছে। সেটার সর্বশেষ অবস্থা আগামী বৈঠকে জানানোর জন্য বলা হয়েছে। এ ছাড়া মিরপুর ও নন্দারবাগ মৌজায় অবৈধ দখলদারের ব্যবহৃত ১.৫০ একর জমির রেকর্ড সংশোধনের নিমিত্ত মামলা দায়েরের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সভায়। জমি উদ্ধারে দ্রুত রেকর্ড সংশোধনের মামলা দায়ের করতে বিএডিসিকে নির্দেশ দিয়েছে কৃষি মন্ত্রণালয়।

বিএডিসির সার গুদাম নির্মাণের জন্য গাজীপুরের টঙ্গী থানার মরকুন মৌজায় ৬৬ শতাংশ জমি অধিগ্রহণ করা হয়। এই জমির অবৈধ দখল উচ্ছেদ ও রেকর্ড সংশোধনের জন্য গাজীপুরের যুগ্ম জেলা জজ দ্বিতীয় আদালতে দেওয়ানি মামলা করা হয়েছে। ইতোমধ্যে বিবাদি মারা গেছেন, এজন্য আরজি সংশোধনের জন্য আইনজীবীর কাছে ডকুমেন্ট প্রেরণ করা হয়েছে। মামলার তদারকির বিষয়ে তৎপর হতে বলা হয়েছে বিএডিসিকে।

বরিশালের গৌরনদী উপজেলার বিএডিসির জমি একটি সরকারি কলেজের ছাত্রাবাস হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। জমি থেকে অবৈধ দখল উচ্ছেদের জন্য জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয়া হয়েছে। সর্বশেষ অবস্থা কী তা পরবর্তী সভায় জানাতে বলা হয়েছে। বিএডিসির মালিকানাধীন বেহাত/বেদখল ভূমি ও স্থাপনা পুনরুদ্ধার সংক্রান্ত ২৫তম সভা অনুষ্ঠিত হয় বিগত ২০১৭ সালের ৬ নভেম্বর। তৎকালীন বিএডিসির চেয়ারম্যান (সম্প্রতি কৃষিসচিব হিসেবে অবসরে গেছেন) মো: নাসিরুজ্জামানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভার কার্যবিরণী থেকে জানা যায়, বিএডিসির কাশিমপুর কোনাবাড়ি ও আশুলিয়ার কাছে কিছু জমি স্থানীয় স্কুল/পার্কের দখলে রয়েছে এবং গণকবাড়ী জমির কিছু অংশ জনৈক ব্যক্তির বাগানবাড়ী হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ওই জমি থেকে অবৈধ দখলদার উচ্ছেদের জন্য গাজীপুর জেলা প্রশাসককে চিঠি দেয়া হয়।

গত ২১ জানুয়ারি বিএডিসি চেয়ারম্যান মো: সায়েদুল ইসলামের সভাপতিত্বে বিএডিসির উইং ও বিভাগীয় প্রধানদের সমন্বয়ে জানুয়ারি মাসের সমন্বয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। ওই সমন্বয় সভার কার্যবিবরণী থেকে জানা যায়, বিএডিসির আইন বিভাগের দেয়া তথ্য মতে সারা দেশে জমির মালিকানা ও গুদামের দখল হস্তান্তর সংক্রান্ত ৮৪টি মামলা চলমান রয়েছে। সভায় সাধারণ পরিচর্যা বিভাগ জানায়, বিএডিসির অরক্ষিত/পরিত্যক্ত স্থাপনা এবং বেহাত/বেদখলকৃত সম্পদের তালিকা চেয়ারম্যান বরাবর পাঠানো হয়েছে। অরক্ষিত/পরিত্যক্ত স্থাপনা এবং বেহাত/বেদখলকৃত সম্পদ উদ্ধারের ব্যবস্থা করতে সাধারণ পরিচর্যা বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট সব দফতর ও বিভাগকে নির্দেশনা দেয়া হয়। এ ছাড়া কোনো উইংয়ে কতটুকু জমিজমা বেহাত/বেদখল আছে তা প্রতি মাসে মিটিং করে প্রকাশ করার জন্য বলা হয়। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের কৃষিমন্ত্রী থাকা অবস্থায় মতিয়া চৌধুরী এক অনুষ্ঠানে বিএডিসির জমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের দায়িত্বশীল হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। কৃষি মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত সংসদীয় কমিটির বর্তমান সভাপতির দায়িত্ব পালন করা মতিয়া চৌধুরী বলেন, ‘সরকারি সম্পত্তি রক্ষায় সকল কর্মকর্তাকে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখতে হবে। কোনো আবাসন কোম্পানি বা দখলদারের সাথে হাত মেলানোর ইচ্ছে থাকলে সরকারি চাকরি ছেড়ে তাদের সাথে যোগ দেন। তাতে সরকার লাভবান হবে।’

বিএডিসির সাধারণ পরিচর্যা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক এসএএম সাঈব নয়া দিগন্তকে বলেন, বিএডিসির চেয়ারম্যান মহোদয় সংস্থার আওতাভুক্ত সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণ ও সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার জন্য অত্যন্ত তৎপর রয়েছেন। জমিজমার যাবতীয় তথ্য হালনাগাদ করার জন্য বিভাগীয় প্রধানদের নিয়ে সভা করে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। বিএডিসির বেদখলকৃত জমির বিষয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে বেহাত সম্পত্তি পুনরুদ্ধারে বিভিন্ন আদালতে মামলা চলমান রয়েছে। এসব মামলা শুনানির কার্যক্রম ত্বরান্বিত করতে বিএডিসির আইন বিভাগকে তাগাদা দেয়া হচ্ছে। অনেক মামলার কার্যক্রম প্রায় নিষ্পত্তির পথে। তিনি বলেন, যেসব জমিতে বাউন্ডারি নির্মাণ সম্ভব হয়নি সেগুলো যাতে বেহাত না হয় সেজন্য সীমানা প্রাচীর নির্মাণ সংক্রান্ত একটি প্রকল্প প্রস্তাব প্রণয়নের জন্য নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। আশা করা হচ্ছে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ প্রকল্পটি অনুমোদন দেবে। এটি হলে সীমানা প্রাচীর নির্মাণ করা হবে। সম্প্রতি ঢাকার দোহারে সার ব্যবস্থাপনা উইংয়ের বেদখলকৃত ১৬ শতাংশ জমিতে বিএডিসির স্বত্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেও জানান এ কর্মকর্তা।


আরো সংবাদ



premium cement