২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

একজন নাগরিককে জন্ম থেকে মৃত্যু একটি নাম্বারে চিহ্নিত করা সম্ভব হবে?

১০ বছর পুরো হরেই আঙুলের ছাপসহ বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করা হবে। - ছবি : বিবিসি

বাংলাদেশে জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটি নাম্বার দিয়ে একজন নাগরিককে চিহ্নিত করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

সরকারের এই পরিকল্পনা অনুযায়ী জানুয়ারি মাসেই শুরু করা হচ্ছে শিশুদের ১০ ডিজিটের একটি নাম্বার দেয়ার কার্যক্রম।

এই নাম্বারের নাম দেয়া হয়েছে ইউনিক আইডি নাম্বার।

কর্তৃপক্ষ বলেছে, স্কুল কলেজে ভর্তি এবং হাসপাতালে চিকিৎসা সেবাসহ বিভিন্ন নাগরিক সুবিধা পেতে এই নাম্বার বাধ্যতামূলক করা হবে।

কিন্তু এমন উদ্যোগের প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নেই নানা আলোচনা চলছে। এর বাস্তবায়নের জটিলতার প্রশ্নও আলোচনায় এসেছে।

শিশুদের নাম্বার কেন?
দেশে আইন করে শিশুদের জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক করা হয়েছে অনেক আগে।

সরকারের জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের সাবেক একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, কোনো শিশুর জন্ম নিবন্ধনের ক্ষেত্রেই বাবা-মায়ের নামসহ বিভিন্ন তথ্য দিতে হয়। স্কুলে ভর্তিসহ বিভিন্ন সুবিধা পেতে এখন শিশুদের জন্ম সনদের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এখন ইউনিক আইডি দেয়ার এই উদ্যোগ নিয়ে তার প্রশ্ন রয়েছে।

প্রয়োজনীয়তার প্রশ্নে কর্তৃপক্ষ যুক্তি হিসেবে তুলে ধরছে নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করা এবং অন্যদিকে সন্ত্রাস-দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপরাধ দমনে সহজে তথ্য পাওয়ার বিষয়কে।

কর্তৃপক্ষ বলেছে, কোনো শিশুকে ইউনিক নাম্বার দেয়ার মাধ্যমে জন্মের প্রথম দিন থেকেই একজন নাগরিকের তথ্য রাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় তথ্যভাণ্ডারে যুক্ত হবে।

নির্বাচন কমিশনের জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: সাইদুল ইসলাম বলেছেন, অনেক সময় সন্ত্রাস এবং দুর্নীতিসহ বিভিন্ন অপরাধের সাথে জড়িতরা নাম-পরিচয়, জন্মতারিখ পাল্টিয়ে ফেলে। কিন্তু জন্মের প্রথম দিন থেকেই রাষ্ট্রের কাছে কোনো নাগরিকের তথ্য থাকলে তা পাল্টানোর সুযোগ কমে যাবে বলে তিনি মনে করেন।

তিনি আরো বলেছেন, জন্ম থেকেই নাগরিকের তথ্য যখন থাকবে, তখন অপরাধ দমনে সেই তথ্য সহায়ক হবে।

ব্রিগেডিয়ার ইসলাম উল্লেখ করেছেন, শিশু বয়স থেকেই একটি ইউনিক নাম্বারের মাধ্যমে নাগরিক অধিকার এবং সুবিধা নিশ্চিত করা সহজ হবে।

তিনি আইনের বাধ্যবাধকতার কথাও তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, ‘২০১০ সালের জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন রয়েছে। সেই আইনে দেশের প্রত্যেক নাগরিককে পরিচয়পত্র দেয়ার বাধ্যবাধকতা আছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল অনুসারেও ২০৩০ সালের মধ্যে প্রত্যেক নাগরিককে জাতীয় পরিচয়পত্র দিতে হবে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যই এখন শিশুর জন্মের প্রথম দিন থেকেই ইউনিক নাম্বার দিয়ে এর আওতায় আনার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে’ বলে তিনি উল্লেখ করেন।

কর্তৃপক্ষ বিশেষভাবে উল্লেখ করেছে, এখন একজন নাগরিককে জন্ম নিবন্ধন নাম্বার, জাতীয় পরিচয়পত্র নাম্বার, ভোটার নাম্বার, আয়কর টিন নাম্বার, ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট নাম্বার, পাসপোর্ট নাম্বার- এ ধরনের অনেক নাম্বার ব্যবহার করতে হয়। কিন্তু ইউনিক আইডি নাম্বার দেয়া হলে সব ক্ষেত্রে এই একটি নাম্বার ব্যবহার করে সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।

কর্তৃপক্ষ বলেছে, একজন নাগরিক জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একটি নাম্বার ব্যবহার করবেন এবং মৃত্যুর পরও সেই নাগরিক সম্পত্তি বণ্টন ভাগাভাগির ক্ষেত্রে ওই নাম্বার বাধ্যতামূলক করা হবে।

নাম্বার দেয়ার পদ্ধতি
জন্মের প্রথম দিন, অর্থ্যাৎ শূন্য বয়স থেকে ১০ বছরের নিচে আর ১০ থেকে ১৭ বছর বয়স পর্যন্ত- এই দুই ভাগে ভাগ করে ইউনিক আইডি নাম্বার দেয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মগহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: সাইদুল ইসলাম জানিয়েছেন, জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন অধিদফতরে শিশুর জন্ম নিবন্ধনের সময় শিশুর নাম, জন্ম তারিখ এবং বাবা-মায়ের নাম দিতে হয়। এখন থেকে এর সাথে বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম্বার দিতে হবে।

শিশুর জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে নিবন্ধন অধিদফতরে এসব তথ্য দিয়ে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করতে হবে।

ব্রিগেডিয়ার ইসলাম বলেছেন, ‘জন্ম নিবন্ধন অধিদফতরই সারাদেশে এই আবেদন গ্রহণ করবে। এই অধিদফতরের সার্ভারের সাথে আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভাণ্ডারের সার্ভার যুক্ত করে দেয়া হবে। জন্ম নিবন্ধন অধিদফতর শিশু তথ্যগুলো আমাদের সার্ভারে পাঠাবে। এর ভিত্তিতে আমাদের সার্ভার জেনারেটর একটা নাম্বার প্রস্তুত করে তা পাঠাবে। এটিই হবে ইউনিক নাম্বার।’

তিনি উল্লেখ করেছেন, ‘এই নাম্বারটি মানুষ তৈরি করবে না। নাম্বারটি সার্ভার জেনারেটর এলগরিদমের মাধ্যমে তৈরি করে দেবে। শিশুর বাবা-মায়ের জাতীয় পরিচয়পত্রের নাম্বারের ভিত্তিতে তথ্য যাচাই করে সার্ভার জেনারেটর ইউনিক নাম্বারটি তৈরি করবে।’

১০ থেকে ১৭ বছরের জন্য
কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১০ বছর পুরো হওয়ার পর কোনো শিশু যখন ১১ বছরে পা দেবে, তখন তার বায়োমেট্রিক তথ্য সংগ্রহ করে ইউনিক নাম্বারের সাথে যুক্ত করা হবে।

বায়োমেট্রিক তথ্য হিসাবে ফিঙ্গার প্রিন্ট ও চোখের আইরিশের তথ্য নেয়া হবে এবং ছবি তোলা হবে। এসব তথ্য ইউনিক নাম্বরের সাথে যুক্ত করে ১০ থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত বয়সীদের লেমিনেটেড জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া হবে। কিন্তু তারা ভোটার হবে না। তথ্যভাণ্ডারে সেভাবেই তথ্য থাকবে।

কর্মকর্তারা বলেছেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার জন্য যে টিম সারাদেশে আগে কাজ করেছে। দেশকে ১০টি অঞ্চলে ভাগ করে সেই টিমগুলোকে স্কুলগুলোতে পাঠিয়ে ১০ থেকে ১৭ বছর বয়সীদের বায়োমেট্রিকসহ সব তথ্য সংগ্রহ করা হবে।

কর্তৃপক্ষ আরো বলেছে, ১৮ বছর পুরো হলে তখন দেয়া হবে স্মার্ট কার্ড এবং ভোট দেয়ার অধিকার পাবে।

বাস্তবায়ন সম্ভব কি?
বিশেষজ্ঞদের মধ্যে অনেকে বলেছেন, জন্মও মৃত্যু নিবন্ধন অধিদফতরকে নির্ভর করতে হয় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা এবং ইউনিয়ন পরিষদের ওপর।

সারাদেশে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার জন্ম নিবন্ধন কার্যক্রম এখনো ডিজিটাল হয়নি। এছাড়া স্থানীয় সরকার ব্যবস্থার বিভিন্ন স্তর থেকে জন্ম সনদ দেয়ার বিষয়ে নানা অভিযোগও রয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে জেলা-উপজেলায় এবং গ্রাম পর্যায়ের শিশুদের ইউনিক নাম্বার দেয়া আসলে সম্ভব হবে কিনা-সেই প্রশ্ন রয়েছে বিশেষজ্ঞদের অনেকের।

জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্যভাণ্ডারের সীমাবদ্ধতা এবং দক্ষ লোকবলের অভাবের কথাও তুলেছেন বিশেষজ্ঞরা।

সাবেক একজন নির্বাচন কমিশনার অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন যে কমিশনে ছিলেন, সেই নির্বাচন কমিশন ২০০৭ সালে নাগরিকদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়ার ব্যবস্থা নিয়েছিল। তখন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তা দাবি করেছিল।

সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, ‘আমি নিশ্চিত, জাতীয় পরিচয়পত্রের তথ্য ভাণ্ডারের যে ক্ষমতা বা ক্যাপাসিটি আছে, তাতে শূন্য থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত বয়সের বিরাট জনগোষ্ঠীর তথ্য সংরক্ষণ করে রাখা বেশ কঠিন হবে। এজন্য আলাদা সার্ভার করতে হবে। এছাড়া নির্বাচন কমিশনের এই উইংয়ে লোকবলের অভাব আছে, এটিও বড় সমস্যা। আর দক্ষ জনবলও নেই।’

জাতীয় পরিচয়পত্র নিয়েই বিভিন্ন সময় নানা অভিযোগ ওঠে। এই পরিচয়পত্র দেয়ার ক্ষেত্রে নানা অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগে বিভিন্ন সময় অনেক মামলাও হয়েছে।

সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, যে জনবল এবং অবকাঠামো এখন আছে তা দিয়ে এই কাজ বাস্তবায়ন সম্ভব হবে- এ ব্যাপারে তার সন্দেহ রয়েছে।

কর্তৃপক্ষ কি বলছে?
জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো: সাইদুল ইসলামের বক্তব্য হচ্ছে, জন্মের প্রথম দিন থেকে ১৭ বছর পর্যন্ত বয়সীদের ইউনিক নাম্বার দেয়ার এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কোনো জটিলতা তারা দেখছেন না।

তারা পাঁচ বছরের মধ্যে এই কাজ শেষ করতে পারবেন বলে আশা করেন।

তিনি জানিয়েছেন, তথ্যভাণ্ডারের সার্ভারের ক্ষমতা ইতিমধ্যেই বাড়ানো হয়েছে এবং সার্ভারের ক্ষমতা আরো বাড়ানোর জন্য প্রকল্পও সরকার অনুমোদন করেছে।

তিনি উল্লেখ করেছেন, শিশুদের তথ্য সংগ্রহ করবে জন্ম ও মৃত্যু নিবন্ধন অধিদফতর এবং স্থানীয় সরকার ব্যবস্থাগুলো। সেজন্য ইতিমধ্যে অধিদফতরের সাথে তাদের চুক্তিও স্বাক্ষর হয়েছে। এই নেটওয়ার্কে কোনো সমস্যা হবে না। আর ১০ বছরের বেশি বয়সীদের তথ্য স্কুলগুলো থেকে সংগ্রহ করা হবে। ফলে বিষয়টি অসম্ভব নয় বলে তিনি মনে করেন।

কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ১৬ কোটির বেশি জনসংখ্যার এখন প্রায় ১১ কোটি মানুষের তথ্য সংরক্ষণ করা হচ্ছে।

সেখানে প্রায় ১১ কোটি মানুষকে জাতীয় পরিচয়পত্র দেয়া এবং এর ব্যবহার নিশ্চিত করার বিষয়কে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরছে কর্তৃপক্ষ।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement