১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সরকারি চাকরিতে বেতন বেড়েছে, কিন্তু দুর্নীতি কমেছে কি?

-

সম্প্রতি ঢাকার মিরপুরে একটি ভূমি অফিসে গিয়েছিলাম। অফিসটিতে ভূমির কর নেয়া হয়। অফিসের ভেতরে ঘুরে দেখলাম শতশত ফাইলের স্তুপ। এই অফিসে যারা আসছেন তাদের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানতে পারলাম, ভূমির কর পরিশোধ করতে হলেও এখানে ঘুষ দিতে হয়। যদিও বিষয়টি ভূক্তভোগিরা সাংবাদিকদের সাথে আনুষ্ঠানিকভাবে কথা বলতে চান না।

তাদের আশংকা নাম প্রকাশ করে দুর্নীতির অভিযোগ করলে পরে নানা ঝামেলায় পড়তে হবে। এর চেয়ে নীরবে ঘুষ দিয়ে কাজ আদায় করে নেয়াটাই তারা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন।

ঢাকায় ভূমি অফিস, রাজউক এবং সিটি করপোরেশনের বিভিন্ন অফিস ঘুরে কম-বেশি একই চিত্র পাওয়া গেল। ঘুষ ছাড়া কাজ হয়েছে এমন ঘটনা বিরল। বিভিন্ন সেবা নেবার জন্য সরকারি অফিসগুলোতে যারা যান, তাদের অভিযোগের অন্ত নেই।

সরকারি অফিস মানেই ঘুষ?

ঢাকার একজন বাসিন্দা মনিসা বলেন, যে কোন কাজে সরকারি অফিসে যেতে হলে তার বাড়তি মনোবলের প্রয়োজন হয়। ‘ঘুষের ব্যাপারটা খুবই কমন। যারা দিচ্ছে তারাও মনে করে যে বিষয়টা স্বাভাবিক। সবার আগে মাথায় থাকে যে সরকারি অফিসে যাচ্ছি। বিড়ম্বনার কথা তো মাথায় থাকেই,’ বলছিলেন তিনি।

বাংলাদেশে দুর্নীতি মোকাবেলার জন্য দুর্নীতি দমন কমিশন রয়েছে। বিভিন্ন সময় তাদের সন্দেভাজনদের সম্পদের হিসাব, জিজ্ঞাসাবাদ কিংবা মামলা করতে দেখা যায়। এগুলো বেশ ফলাও করে প্রচারও করা হয়।

কমিশনের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হচ্ছে, ২০১৮ সালে বিভিন্ন দুর্নীতির মামলায় ৫৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে, এদের মধ্যে ২৮ জন সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারী।

প্রভাবশালীরা আওতার বাইরে?

দুর্নীতি-বিরোধী বেসরকারি সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-এর নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলছেন, দুর্নীতির দায়ে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের অনেকেই নিম্নপদস্থ কর্মচারী। কোন মন্ত্রণালয়ে বা সরকারি সংস্থায় দুর্নীতির জন্য সেখানকার সচিব কিংবা শীর্ষ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করার নজির একেবারেই নেই।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার ব্যক্তিরা বলছেন, ভূমি অফিস, রাজউক কিংবা সিটি করপেরেশনের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোতে ব্যাপক দুর্নীতি থাকলেও এসব প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শীর্ষ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে কোন মামলার নজির নেই। অনেক সমালোচনা এবং আলোচনার পরেও সাবেক ফারমার্স ব্যাংকের চেয়ারম্যান ও আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন খান আলমগীর এবং বেসিক ব্যাংকের সাবেক চেয়ারম্যান আব্দুল হাই বাচ্চুকে দুর্নীতি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়নি।

অনেকে ক্ষেত্রেই প্রভাবশালীরা পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন টিআইবির ইফতেখারুজ্জামান।

তিনি বলেন, ‘নিম্ন কিংবা নিম্ন মধ্যম পর্যায়ের কর্মচারী বা কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে যখন অভিযোগ আসে তখন দুর্নীতি দমন কমিশনকে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়। বিশেষ করে উচ্চ পর্যায়ের যারা তাদেরকে বিচারের আওতায় আনার দৃষ্টান্ত খুব কম ক্ষেত্রেই দেখা যায়।’

বেতন বৃদ্ধি কোন সুফল দেয়নি

বছর তিনেক আগে সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়েছে শতকরা ৮০ শতাংশ পর্যন্ত। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটি ছিল নজীরবিহীন ঘটনা। সরকারের তরফ থেকে যুক্তি দেখানো হয়েছিল, বেতন ভাতা বৃদ্ধি করলে সরকারি অফিসে দুর্নীতির প্রবণতা কমে আসবে। কিন্তু বাস্তবে সেটির কোন প্রতিফলন দেখা যায়নি।

কমিশনের প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, ২০১৮ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন ২১৬টি মামলা দায়ের করেছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে দুর্নীতির যে ব্যাপকতা সে তুলনায় এই মামলার সংখ্যা সমুদ্রের কয়েক ফোঁটা পানির মতো।

তবে কমিশনের যুক্তি হচ্ছে, মামলা দায়ের করার ক্ষেত্রে তারা বেশি সতর্কতা অবলম্বন করছেন এবং এ ক্ষেত্রে দালিলিক প্রমাণের উপর গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, সরকারি অফিসে দুর্নীতির রাশ টেনে ধরার জন্য তারা আদৌ সফল হচ্ছেন কিনা? মাহমুদ বলেন, ‘পুরোপুরি আমরা সফল নই, তবে চেষ্টা করার ক্ষেত্রে আমরা সফল। প্রায়ই সমালোচনা করা হয় যে দুদক চুনোপুঁটি ধরে। সরকারি পরিষেবা দেবার ক্ষেত্রে দুর্নীতি হচ্ছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। আমরা প্রতিদিন ১৫টির মতো অভিযান পরিচালনা করি। আমাদের সক্ষমতার মধ্যে যা আছে।’

দুর্নীতির বিরুদ্ধে যারা সোচ্চার তারা বলছেন, সরকারি খাতে বড় অংকের বেতন বৃদ্ধির ফলে দুর্নীতি তো কমেইনি বরং আরো বেড়ে গেছে। এর একটি বড় জায়গা হচ্ছে, বেতন বৃদ্ধির কারণে সরকারি চাকরি পেতে অনেকে মরিয়া হয়ে উঠছেন। ফলে চাকরি দেবার ক্ষেত্রে অনেকে জায়গায় ঘুষের লেনদেন বেড়েছে। এছাড়া বেতন বৃদ্ধির কারণে জীবনযাত্রার ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় ঘুষের পরিমাণও বেড়েছে।

‘পৃথিবীর কোন দেশেই শুধু বেতন বাড়িয়ে দুর্নীতি বন্ধ করা যায়নি। আইনের প্রয়োগ লাগবে। দুর্নীতি করলে শাস্তি পেতে হবে, সে জায়গায় যাওয়া যায়নি,’ বলছিলেন টিআইবির মো. ইফতেখারুজ্জমান।

দুর্নীতি নিয়ে রাস্তাঘাটে সাধারণ মানুষের সাথে কথা বললেই তাদের মুখ থেকে চরম হতাশা এবং ক্ষোভ শোনা যায়। দুর্নীতি দমন কমিশন কিংবা সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে যতই কথা বলুক তাতে খুব একটা আশাবাদী হতে পারছেন না সাধারণ মানুষ।

ঢাকার রাস্তায় এক নারী বলছিলেন, ‘ভবিষ্যতে আমরা কী করবো, কোথায় যাবো? এটা আমাদের চিন্তার একটা কারণ। ঘুষ ছাড়া কোন কিছু হচ্ছে না।’

সাজা পাচ্ছে কয়জন?

দুর্নীতি দমন কমিশন বলছে, তাদের পক্ষ থেকে যেসব মামলা দায়ের করা হচ্ছে সেগুলোতে সাজার হার প্রায় ৬০ শতাশ। যদিও আপিল বিভাগ পর্যন্ত সে সাজা নিস্পত্তির হার একেবারেই হাতে গোনা। দুর্নীতির মামলা আদালতে নিস্পত্তি হতে বছরের পর বছর সময় লেগে যাচ্ছে। ফলে যাদের বিরুদ্ধে মামলা হচ্ছে তারা শেষ পর্যন্ত কতটা সাজা পাচ্ছে সেটি অনেকে মনেও করতে পারেন না। তাছাড়া অনেক সময় দুর্বল তদন্তের কারণেও অভিযুক্তরা পার পেয়ে যাচ্ছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনের হয়ে আদালতে মামলা লড়েন আইনজীবী খুরশিদ আলম। তিনি বলেন, একটি দুর্নীতির মামলায় আদলতে প্রমাণ করা বেশ কষ্ঠসাধ্য, যদি তদন্ত ঠিক মতো না হয়।

‘দুর্নীতিতে অভিযুক্ত একজন ব্যক্তি যখন হাইকোর্টে এসে চ্যালেঞ্জ করবে, তখন আপনি বলতে পারবেন না যে হাইকোর্ট ভুল করেছে। আপনাকে সেটা আইনগতভাবে কনটেস্ট করতে হবে। তারপর সেটা ক্লিয়ার করতে হবে। দক্ষ প্রসিকিউটর লাগবে। এখন যে ধরণের ফিনান্সিয়্যাল ক্রাইম হচ্ছে, সেটি অনেক পাল্টে গেছে। তদন্তের কোয়ালিটি আরো বাড়াতে হবে,’ বলছিলেন আলম।

শুধু মামলা দিয়ে দুর্নীতি দমন সম্ভব?

দুর্নীতি দমন কমিশন মনে করে, শুধু মামলা কিংবা অভিযান পরিচালনা করে দুর্নীতি কমানো সম্ভব নয়। এজন্য সিস্টেম পরিবর্তন করতে হবে। কমিশনের চেয়ারম্যান ইকবাল মাহমুদ বলেন, যেসব সরকারি সংস্থায় দুর্নীতির ব্যাপকতা বেশি, সে ধরণের বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে কাজের পদ্ধতি পরিবর্তন করার চেষ্টা করা হচ্ছে।

‘ডিজিটাল ব্যাবস্থাপনা চালু করে হিউম্যান টাচ যদি কমানো যায় তাহলে দুর্নীতির সুযোগ কমে আসবে। শুধু মামলা কিংবা অভিযান দিয়ে দুর্নীতি কমানো যাবে না।’ 

তবে একটি ধারণা জনমনে বেশ প্রবল। সেটি হচ্ছে, দুর্নীতির মামালা দায়েরের ক্ষেত্রে কমিশন সরকারের মনোভাবের দিকে তাকিয়ে থাকে। অভিযোগ রয়েছে, সরকার অসন্তুষ্ট হতে পারে, এমন কোন ব্যক্তির বিরুদ্ধে কমিশন দুর্নীতির অভিযোগ আনতে চায়না। যদিও সংস্থাটির চেয়ারম্যান দাবি করছেন এ ধরেণের অভিযোগ সত্য নয়।

কমিশন বলছে, সাবেক মন্ত্রী ও বর্তমানে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুল মান্নান খানের বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা চলছে। এছাড়া সংসদ সদস্য থাকা অবস্থায় দুর্নীতির মামলায় সাজা হয়েছে ককক্সবাজারের সাবেক এমপি আব্দুর রহমান বদি। 

এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ে কয়েকজন যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে দুর্নীতির মামলা উদাহরণ তুলে ধরা হচ্ছে কমিশনের পক্ষ থেকে।

যদিও সমালোচকরা বলছে, দুর্নীতি দমন কমিশন তাদের বিরুদ্ধেই মামলা করছে যারা সরকারের শীর্ষ পর্যোয়ের সুনজর থেকে দুরে সরে গেছে।

সূত্র : বিবিসি


আরো সংবাদ



premium cement
গাজায় ইসরাইলি হামলায় নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়াল শ্যালকের অপকর্মে দুঃখ প্রকাশ করলেন প্রতিমন্ত্রী পলক রাজশাহীতে ট্রাকচাপায় ৩ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত পাবনায় দুই গ্রুপের সংঘর্ষে হতাহত ২২ বিল দখলের চেষ্টা, জেলা ছাত্রলীগ নেতাকে গণপিটুনি ‘শাহাদাতের তামান্নায় উজ্জীবিত হয়ে কাজ করলে বিজয় অনিবার্য’ কারাগারে নারী হাজতিকে হাত-পা বেঁধে নির্যাতন, প্রধান কারারক্ষীসহ ৩ জনের বদলি প্যারিসে ইরানি কনস্যুলেটে ঢুকে আত্মঘাতী হামলার হুমকিদাতা গ্রেফতার প্রেম যমুনার ঘাটে বেড়াতে যেয়ে গণধর্ষণের শিকার, গ্রেফতার ৫ ‘ব্যাংকিং খাতের লুটপাটের সাথে সরকারের এমপি-মন্ত্রী-সুবিধাবাদী আমলারা জড়িত’ ইরানের সাথে ‘উঁচু দরের জুয়া খেলছে’ ইসরাইল!

সকল