২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ঘাসফড়িঙের পিছু দৌড়ানো দিন

ঘাসফড়িঙের পিছু দৌড়ানো দিন -

মনে পড়ে, মাদরাসায় পড়া জীবনের চৌকাঠ ধরে বের হওয়া অবারিত শৈশবের দিন। আমাদের গ্রাম থেকে মাদরাসাটি ছিল দূরে। আবাসিক মাদরাসার দিনগুলো ছিল বন্দী খাঁচার মতো। আমি অজুখানায় গিয়ে বসে থাকতাম। মসজিদের গ্রিল ধরে চেয়ে থাকতাম পথের দিকে। আব্বা আমাকে মাদরাসায় একলা রেখে যেই পথ দিয়ে চলে গিয়েছিলেন, সেই পথের দিকে। মায়ের ভালোবাসা, বাবার স্নেহ একটু একটু বুঝতে পারার দিনে নিজের ঘর থেকে অপসারণ হওয়ার কারণে আমার এক ধরনের নির্বোধ অস্থিরতা কাজ করত। মুখখানা ম্লান করে আমি একা একা ঘুরে বেড়াতাম মাদরাসা মাঠের পাশ ঘেঁষে বয়ে যাওয়া খালপাড় দিয়ে। কখনোবা বাঁশের সাঁকো বেয়ে খাল পার হয়ে অপর পাড়ের বিশাল রেইন ট্রি গাছের তলায় যেখানে কেউ যায় না, সেখানে বসে বসে দিগন্তে ধূসর মেঘ ঘনিয়ে আসতে দেখতাম। সেই ধূসর রঙের মেঘে আমি দুঃখ খুঁজতাম। এভাবে কেটে যায় দিন সপ্তাহ মাস, ক্রমে অনিবার্যহেতু মানিয়ে নেয়া এক বোধ জেগে উঠত আমার ভেতর। তবুও মায়া টান ভালোবাসার ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠি শরীরে। অকস্মাৎ গড়ে ওঠা ক্লান্তি আর বদলে যাওয়ার পর সব নিঃসঙ্গতাকে দূরে ঠেলে সন্ধ্যায় মাদরাসার সামনের বিশাল মাঠে আমরা খেলায় মেতে উঠতাম। খেলা করতাম সবুজরঙা ঘাসফড়িঙদের সাথে।
একবার খুব জ্বর করেছিল আমার। ছাত্র ভাইয়েরা আমাকে শুয়ে থাকার পরামর্শ দিলো। তারপর হুজুর আমাদের বাড়িতে কল করে জানালেন আমার জ্বরের কথা। চার দিকে ঘন বন, মাঝখান দিয়ে আঁকাবাঁকা মেঠোপথ। কোথাও কেউ নেই, শুধু বাতাসের শাঁ শাঁ আনাগোনা বনের ভেতর। এমন শান্ত নিবিড়। যেন নক্ষত্ররাও তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে সব। যেন শৃঙ্খলের ভেতরেই চলছিল পৃথিবী। বনের জনমানবশূন্য রাস্তা দিয়ে আঁধারের বুক চিরে আব্বা একা একা ছুটে এলেন মাদরাসায়। আমার শরীরে হাত দিয়ে জ্বরের পরিমাপ নিলেন। জ্বরের তীব্র উত্তাপ দেখে আমাকে আর মাদরাসায় রেখে যেতে সায় দিলো না আব্বার ভিজে ওঠা মন। আমাকে কাঁধে উঠিয়ে নিয়ে অন্ধকারের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে হাঁটা ধরলেন, বন হয়ে যেই পথ চলে গেছে আমাদের গ্রামের দিকে। সেই পথে।
বনের দীর্ঘপথ মাড়িয়ে বাড়িতে পৌঁছে দেখলাম, কুপি বাতির আলোয় আমাদের অপেক্ষায় বসে আছেন আম্মা। আম্মার চোখের ভেতর যেন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল তার দুঃখী দুঃখী মন। মনের মাঝে বইছে দুঃখের এক তরঙ্গ। আমি সেই তরঙ্গ বুঝতে পারি, স্পষ্ট, অধীর। আম্মা বুকে জড়িয়ে নিলেন আমাকে। আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। তারপর কালিমা তাইয়্যিবা পড়তে লাগলেন এক নাগাড়ে। আমাকেও সাথে সাথে আওড়াতে বললেন। ঠোঁটে ঠোঁটে আম্মার সাথে সেই কালিমা আওড়ানোর তালে তালে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি, তারপর আর মনে নেই।
শৈশব জীবনের সেই মাদরাসা, মাদরাসার সামনের সেই গাঢ় সবুজে ঘেরা বিশাল মাঠ, বিকেলের নরম নরম রোদ, কেমন আছে তারা? কেমন আছে সেই সবুজরঙা ঘাসফড়িঙের দল, ঘাস, তৃণলতা। কতদিন হয়ে গেল তারা আমার একাকিত্বের সঙ্গী হয় না। এখন মনে হয়, সেসব ছিল কেবল অলীক স্বপ্ন। ঘুম ভেঙে গেলে যেন তারাও মিলিয়ে গেল স্বপ্নের মতো।

 


আরো সংবাদ



premium cement