২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বাবা, তোমাকে বলা হয়নি...

বাবা, তোমাকে বলা হয়নি... -

বাবা মানে এক সমুদ্র আবদার, অভিমান, অভিযোগ, অনুযোগের পেছনে প্রশান্ত মহাসাগর সমান লুকানো ভালোবাসা। মধ্যবিত্ত পরিবারে ঈদ মানেই প্রিয় মানুষের চাওয়া, আকাক্সা জলাঞ্জলি দিয়ে বরং তার সবচেয়ে প্রিয় মানুষদের ইচ্ছেগুলো হাসিমুখে পূরণ করা। শুধু ঈদ না, সবসময়ই এ রকম নিজেকে শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়ে বাবা তার সন্তানের শখ মেটান। সন্তানের মুখের হাসি যে তার কাছে অমূল্য। ঈদ আসলে নতুন জামা থেকে মেহেদি পর্যন্ত সবই একে একে কেনা হয়। ঝামেলা বাঁধে আব্বুর জন্য কিছু কিনতে গিয়ে। তিনি কিছুতেই কিছু কিনবেন না। তার একই কথা, আগেকার ঈদের পাঞ্জাবি তো আছে। হাসিমুখে শুধু আমাদের শখগুলোই পূরণ করে যান। একবার ঈদে আমার বৃত্তির জমানো টাকা দিয়ে পাঞ্জাবি আর জুতা কিনে দিলাম। মুখে না বললেও চোখেমুখে আনন্দের অভিব্যক্তি স্পষ্ট । ইশ্শ! কবে যে এমন আনন্দে উদ্ভাসিত মুখ প্রতিদিন দেখার সুযোগ হবে!
মাথার ওপর শীতল ছায়া বাবা। আড়াল হলেই মনে হয় প্রচণ্ড গুরুত্বপূর্ণ কী যেন নেই, কী যেন নেই। ছোট বেলা যখন বাজারে গেলে সাথে যাওয়ার বায়না করলে নিয়ে যেতেন। পরিচিত কোনো চাচ্চু বা মামার দোকানে বসিয়ে রেখে বাজার করতে যেতেন যাতে সাথে গেলে গরমে কষ্ট না হয়। দোকানে বসে সেই অপো সময় ৫ মিনিটে ৩০ মিনিট মনে হতো। কখন আসবে আব্বু? এমনকি মনে এই আশঙ্কাও কাজ করত, আব্বু আসবে তো! তারপর যখন আসতে তখন হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম মনে হতো।
বাবা মানুষটা আসলে সুপারম্যানের চেয়ে কিছু কম না। ঊর্ধ্বগতির বাজারে শুধু শিকতার টাকা দিয়ে সংসার, পড়ালেখাসহ কত কিছু যে ম্যানেজ করতে হয়। কিভাবে যে করেন, তা এই সুপারম্যান ভালো জানেন। কখনো অন্যায়ের কাছে মাথা নত হতে দেখিনি। পেশাজীবনে কত চাপ, কত বাধা, ইস্পাত দৃঢ় কঠিন ব্যক্তিত্বের সাথে মোকাবেলা করতে দেখেছি। তবু দুর্নীতির পথে পা বাড়াতে দেখিনি। অবৈধ পথে ইনকামের কথা কল্পনাও হয়তো করেননি কখনো। ৩২ বছরের শিক জীবনে তার অসংখ্য গুণমুগ্ধ শিার্থীর মুগ্ধতা দেখে অবাক হই। সহজ-সরল, মায়াময় মানুষটা কী এক অনিন্দ্য আলোয় উদ্ভাসিত। তার এই উজ্জ্বল বর্তিকাই তার কাছ আমার উত্তরাধিকার।


শিক বাবার মেয়ে হয়েও পড়ালেখার হাতেখড়ি মায়ের কাছেই হয়েছে। কারণ টানা ২২ বছর আমাদের থেকে দূরে আরেক জেলাতে শিকতা করেছেন। শুধু ছুটিতেই কাছে পাওয়া যেত তাকে। ছুটিতে আব্বুর বাড়িতে থাকার দিনগুলো হতো বেশ আনন্দের। কত রকমের গল্প, গ্রামের গল্প, মুক্তিযুদ্ধের গল্প। মুক্তিযুদ্ধের সময় এক কিশোরের বাড়িতে রান্না করা খাবার মুক্তিযোদ্ধাদের পরিবেশন করা, অস্ত্র মুছে দেয়ার এসব গল্প যে কতবার শুনেছি তার শেষ নেই। সেই কিশোরটিই আমার আব্বু। গল্প শুনলে মনে হয়, সেসব দৃশ্য যেন চোখের সামনে ভাসে।
স্বভাবসুলভ গাম্ভীর্য থাকলেও কখনো বকা দেননি। অবশ্য আমাদের দুই বোনের কাছে গাম্ভীর্যের এই রূপ একদম আলাদা, মায়াময়। আম্মুর কাছে কঠিন কথা কখনো বা শুনলেও আব্বুর কাছে কড়া কথা, বকা শুনতে হয়নি বললেই চলে। কখনো যদি বলেন, সাথে সাথে চোখে পানি চলে আসে। সম্ভবত কখনো বলেন না বলেই এ রকম। অথচ আম্মু বললে এত সহজে চোখে পানি আসে না, কী অদ্ভুত! কতবার আমার নাম ধরে যে ডেকেছে আব্বু এটা মনে হয় হাতে গুনেই বলে দেয়া যাবে। এখনো সেই ছোট্টবেলার মতো তার কাছে আমি ‘বাবু’ই আছি। কী প্রচণ্ড ভালোবাসা। বটবৃ বাবার ছায়াতলে এসব দিনরাত্রি ভালোই কাটছে। আল্লøাহ আব্বুকে অনেক বছর হায়াত দান করুক। ছোটবেলা যেমন আব্বুর আঙুল ধরে ঘুরতাম তেমনি যেন আব্বু আমার আঙুল ধরে পুরো পৃথিবী ভ্রমণ করতে পারে। বৃদ্ধ বয়সে যেন বন্ধু হয়ে পাশে থাকতে পারি। সব প্রত্যাশা পূরণ করতে পারি।
বলি বলি করেও মধ্যবিত্তীয় সঙ্কোচের বৈতরণী পার করে বলা হয়ে ওঠে না, অস্ফুটে উচ্চারিত কথা , ‘আব্বু, তোমাকে ভালোবাসি!’ বাবা দিবসে সব বাবাকে শ্রদ্ধা।

 

 


আরো সংবাদ



premium cement