২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

‘দুর্গন্ধ বনাম জুতা আবিষ্কার’

‘দুর্গন্ধ বনাম জুতা আবিষ্কার’ -


আজ একটু বেশিই ত্রস্ততা নাদিরার। ডিসি অফিস থেকে খবর এসেছে, আগামী দিন ‘বিশ্ব পরিবেশ দিবস’। প্রতিবারের মতো এবারেও দিবসটিকে কেন্দ্র করে নানা আয়োজন রয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে দিবসকেন্দ্রিক একটি আর্টিকেল লিখতে হবে নাদিরাকে। ছাত্রী জীবনের এই লেখালেখির অভ্যেসটা এখন চাকরি জগতে এসে দিবস ভিত্তিকই আটকে আছে।
তবু তো লিখছে! তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে সে প্রস্তুতিই নিতে হবে নাদিরাকে। তাই তো আজ আর কারোর জন্য অপেক্ষার সুযোগ নেই। সঙ্গী সহকর্মীটি আজ ফিরবেন একটু দেরি করে। তাই আজ একাই পাড়ি দিয়ে যেতে হবে এই বদ্ধ গ্রামটি। রাস্তাঘাটও খুব সুবিধের নয়। চলতে পথে রাস্তার ধারে একটা পচা ডোবা আছে। যা অতিক্রম করতে নাদিরা দুর্গন্ধে বেহুঁশ প্রায় হয়ে পড়ে। আছে কাঁচা গোবরের ঢিবি আর যত্রতত্র মলমূত্রের খোলা চিত্র। তবু চলতে হবে।
দিগন্ত বিস্তৃত সবুজমাঠ, কখনো সরষে ফুলের গালিচা অথবা লালশাক আর পালংশাকের লালসবুজের মেলা দেখতে দেখতে পথচলা ওকে বিমোহিত করে তোলে। গ্রামে চাকরিস্থলের কষ্টটা অনেকটাই ভুলে যায় বটে। কিন্তু যত বিড়ম্বনা গ্রামের ওই সীমানাটুকু পাড়ি দেয়া। অফিস থেকে বের হয়ে ছোট্ট এই গ্রামটা পাড়ি দিতে ওর তিনবার বাহন বদলাতে হয়। সে না হয় হলো কিন্তু যে নোঙরা পরিবেশের মধ্যে দিয়ে আসতে হয় তা আর দ্বিতীয়বার মনে করার মতো নয়। এর মধ্যে বৃষ্টি হলে তো আর যায় কোথা! কাঁদামাটি, দুর্গন্ধ আর নোঙরা জিনিসের ছড়াছড়ি ওকে বিষিয়ে তোলে একদম।


কেবলই ভ্যান থেকে নেমে মোবাইলে সময় দেখে নিলেন নাদিরা বেগম। এবার তার উঠতে হবে অটোরিকশায়। এতে পার হবে গ্রামের উপকণ্ঠ। এরপর রিকশায় উঠবে শহরের উদ্দেশে যা একেবারে বাসার সামনে নিয়ে থামাবে। ভাগ্যিস বাসাটা শহরে ঢুকতেই!
ওই তো একটা অটো আসছে। পুরুষ লোকে ঠাসাঠাসি। তবু একটা সিটের যাত্রী নেমে যাওয়াতে তাতেই উঠে বসলেন নাদিরা। অন্য দিন হলে আরো একটু সময় অপেক্ষা করে প্রায় খালি অটোতে আয়েশ করে যেত নাদিরা। এমন ঠাসাঠাসি করে বসা গাঁয়ের লোকদের শরীরের দুর্গন্ধ নাকে নিয়ে দূরের রাস্তা পাড়ি দেয়া খুবই বিচ্ছিরি-অনাকাক্সিক্ষত বিষয়।
অফিস থেকে বের হয়ে ভ্যানের উদ্দেশে কিছুদূর হেঁটেই এগোতে হয় নাদিরার। আর সেই টুকুন রাস্তাতেও কি জঘন্য অবস্থা! মনে করতেই নাদিরার বমি আসে । তবু প্রতিদিন সেই কাঁচা গোবরের ঢিবি, রাস্তার পার্শ্বেই ত্যাগ করা মল- সবই অতিক্রমের সাথে সাথে রীতিমতো সহ্য করেই পথ চলতে হয় নাদিরাকে। এ নিয়ে কতবার গ্রামের গণ্যমান্যদের মাধ্যমে গ্রামবাসীর সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে দৃষ্টি আকর্ষণ করিয়েছে, পাড়ায় পাড়ায় উঠান বৈঠক করেছে, জনসমাবেশ করেছে যা তার অফিসিয়াল কর্মসূচির আওতাভুক্ত। কিন্তু কে শোনে কার কথা! পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রাখা জাতির নৈতিক দায়িত্ব।
পরিবেশকে সুস্থতার সাথে বাঁচিয়ে রাখা নাগরিক দায়িত্ব।
এ পরিবেশ বলতে নিজের শারীরিক পরিচ্ছন্নতা থেকে শুরু করে চতুর্দিকের সব ধরনের অবস্থাকেই যে বুঝায়; এ কথা কতবার বুঝিয়েছে নাদিরা বেগম গ্রামবাসীকে; কিন্তু ওদের ভাবখানা এমন যেন ‘বকাউল্লা বইল্যা গেল- শোনাউল্লা শুইন্যা রইল’-কাজের কাজ কিছুই না।
পরিবেশবান্ধব কর্মী হিসেবে একটি এনজিওতে চাকরি নিয়েছে নাদিরা। দেশের খুব পিছিয়ে পড়া অঞ্চলগুলোতে তাদের কাজ। সে রকমই একটি ছোট্ট জেলা শহরের এক প্রত্যন্ত ইউনিয়নে তার কর্মস্থল বিধায় প্রতিদিনই তার এই নোঙরা পথে চলা গ্রামের মুখটি দেখতে হয় তাকে।


তবুও সে এখানকার জনগণের সাথে একরকম একাত্মা হয়ে উঠছে যেন দিন দিন। এই যে শুনুন! সিগারেটটা ফেলে দিন দয়া করে। পাশেই বসা গেঁয়োলোকটি বাধ্যঅনুগত বালকের মতো সুখটান ছেড়ে দিয়ে একটু নড়েচড়ে বসল। যাক কিছুটা হলেও বদলেছে জগৎ। পরিবেশ বিধ্বংসী এ ব্যাপারটাতে কাউকেই ছাড় দেন না নাদিরা। জনগণও বেশ সহজেই মেনে নেয় ওর কর্কশ কণ্ঠের নির্দেশনা। টুঁ শব্দটি না করে জলন্ত সিগারেটটি ফেলে দিলো লোকটা একটা বোকার হাসি হেসে দিয়ে।
উহ কি দুর্গন্ধ! রাস্তার পাশেই কোনো বাড়ির খোলা পায়খানা। বৃষ্টির ছিটায় দুর্গন্ধ আরো প্রকট হয়ে বাতাসে বয়ে বেড়াচ্ছে। গ্রামের লোকগুলোর এই আরেক সমস্যা। বাড়ি-ঘরে, সংসারে ইদানীং তারা যতই আধুনিকতার ছোঁয়া লাগানোর প্রতিযোগিতায় মেতে উঠুক না কেন- ওই স্বতঃসিদ্ধ কাজটার ব্যাপারে ততটাই উদাসীন। ওটাকে ঘেরাও দেয়া, লোকচক্ষুর অন্তরালে নেয়া, সেনিটারির পারিপাট্যতায় নিয়ে আসা- এ সবে তাদের ভ্রুপে মাত্র নেই। নোঙরা জিনিসটাকে কোনোমতে নোঙরাভাবে ছেড়ে আসলেই যেন বাঁচা গেল- পরবর্তীর চিন্তা আর থাকেই না ওদের। উন্নত জীবনে মলমূত্র ত্যাগের উন্নয়নও যে একটি বিশেষ বিষয় এ ব্যাপারে গ্রামবাসীর এমন নিষ্পৃহতা নাদিরাকে মর্মাহত করে।
আরে বাপু এটা তো রুচিরও ব্যাপার। বাড়ির ভেতরের দিকের কাজটি বাইরে একেবারে রাস্তার ধারে নিয়ে এসে বসায় কী করে? ওই যে পানি ব্যবহারের শব্দটা পর্যন্ত শোনা যাচ্ছে। কি মূর্খতা! সদোক্তিতে মনটা বিষিয়ে ওঠে নাদিরার।


ওদিকে সামনের সিটে বসা দুই যাত্রী অনর্গল কথা বলে যাচ্ছে, কথার ফাঁকে কাঁশছে, হাঁচি দিচ্ছে আর সেই সাথে তাদের মুখের দুর্গন্ধ! ঘামে সিক্ত শরীরের ভ্যাপসা গন্ধ নাদিরার নাকে এসে লাগছে অব্যাহত। বাধ্য হয়ে ওড়না দিয়ে নাক চেপে ধরতেও সঙ্কোচ লাগছে ওর। লোকগুলো না জানি কী ভাবে! অন্য সময় হলে এ রকম দুর্গন্ধ এড়াতে হাতব্যাগে যতেœ রাখা বডি¯েপ্রটা বের করে টুপ করে নিজের নাকে গলায় ছুড়ে দিত।
একবার এক রিকশাওয়ালার প্যাডেল ঘোরানোর ছন্দে ছন্দে যে শারীরিক দুর্গন্ধ বের হয়ে আসছিল তা ভোলার মতো নয়। কিন্তু পরিবেশবান্ধব কর্মী নাদিরা তৎক্ষণাৎ সাথে রাখা ওই মোম অস্ত্রটি ব্যবহার করে সে যাত্রা রক্ষা পেয়েছিল। আরেকবার অফিসের এক সহকর্মী যার শরীরের ঘর্মাক্ত দুর্গন্ধে পাশে বসাই যেত না। মহিলাটির এতে কোনোই চেতন ছিল না। দুর্গন্ধবিমুখ নাদিরা বুদ্ধি করে ওই সহকর্মীর জন্মদিন জেনে নিয়ে দিবস মতো কিছু কসমেটিকসের সাথে একটা বডি¯েপ্রও উপহার দিয়ে অফিসে বেশ নন্দিত হয়েছিলেন। উদ্দেশ্যটা তো আল্লাহই ভালো জানেন। সে যাত্রা তার ‘সাপও মরল, লাঠিও বাঁচল’।


আরো সংবাদ



premium cement