২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

ইবনে সিনা : যার নেই জ্ঞানের সীমানা

ইবনে সিনা : যার নেই জ্ঞানের সীমানা -

জানার সীমাবদ্ধতা আছে, কিন্তু জানার আগ্রহের সীমানা নেই। একজন ব্যক্তির মধ্যে জ্ঞানের এই বিচিত্র সমাবেশ যদি দেখতে চাওয়া হয়, ইতিহাসে এরকম অনেক ব্যক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু তাদের মধ্যে একজনকে অন্তর্ভুক্ত করতেই হবে। ইবনে সিনা। পুরো নাম আবু আলী সিনা। পশ্চিমে তিনি Avicenna নামে পরিচিত ।
ইতিহাসে তিনি চিকিৎসক হিসেবে পরিচিত। এক হাজার শতাব্দীর পরে যে স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের জন্ম, তা ইবনে সিনার হাত ধরেই হয়েছিল। দেড় হাজার বছর গ্রিক ও রোমানদের স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের হাত থেকে বেরিয়ে যে আধুনিক স্বাস্থ্যবিজ্ঞানের জন্ম হয়, তার জনক বলা যায় ইবনে সিনাকে। তারই ধারাবাহিকতায় আজকে পূর্ব ও পশ্চিমে স্বাস্থ্যবিজ্ঞান তার পূর্ণতার রূপ পেয়েছে।
ইবনে সিনা একাধারে লেখক, চিন্তাবিদ, সমাজ সংস্কারক, বিজ্ঞানী, গণিতবিদ, কবি, ভাষাবিদ, ভ্রমণকারী, রাজনীতিবিদ, আইন বিশেষজ্ঞ, প্রকৃতিবিদ, দার্শনিক, ধর্মীয় বিশেষজ্ঞ ও জ্যোতির্বিদ। একের ভিতর বহু রূপ।
জন্ম ৯৮০ সালে, মৃত্যু ১০৩৭। মাত্র ৫৭ বছর বয়সে এই মহান মনীষীর মৃত্যু । উজবেকিস্তানের অন্যতম একটি বড় শহর বুখারা থেকে ৩০ মাইল দূরে আফসানা গ্রামে তার জন্ম। এই বুখারা শহরেই মুসলিম স্কলার ও হাদিস বিশেষজ্ঞ ইমাম বুখারির জন্ম। তখন এই বুখারা শহরটি সিল্ক রোডের মাঝে একটি অন্যতম বাণিজ্যিক ও শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। সেখানকার বেশির ভাগ অধিবাসী ছিল চার পাশ থেকে আসা তাজিক ও উজবেকরা। ইবনে সিনা ছিলেন উজবেক। জন্মকালে গ্রামে তিনি পরিচিত ছিলেন হোসেন নামে। হোসেনের বয়স যখন পাঁচ বছর, তার পরিবার গ্রাম থেকে বুখারা শহরে চলে আসেন। আর এই বুখারা ছিল সেই সময়ের ইসলামিক সাম্রাজ্য এবং বিশ্বের একটি অন্যতম শিক্ষাকেন্দ্র। ইবনে সিনা সেখানেই লাভ করেন তার শিক্ষা। তারই হাত ধরে রেখে গেছেন তার সব অসামান্য কীর্তি ।
জীবিতকালে তিনি যা লিখে গেছেন তার অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। গবেষণায় জানা গেছে পাঁচশোর বেশি গ্রন্থ লিখে গিয়েছিলেন তিনি। তার অর্ধেক রক্ষা পেয়েছে, সংরক্ষিত হয়েছিল। বিশেষ করে দর্শন ও চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর গ্রন্থগুলো এখনো সংরক্ষিত আছে। শুধু চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর ৫০-এর বেশি গ্রন্থ লিখেছেন তিনি, যা পরে মডার্ন মেডিক্যাল সাইন্সকে পথ দেখায়। বিশেষ করে তার রচিত The Canon of Medicine গ্রন্থটি ইউরোপে ১৭ শতাব্দী পর্যন্ত মেডিসিনের প্রধান বই হিসেবে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হতো। ১০২৫ সালে পাঁচটি খণ্ডে গ্রন্থটি সংরক্ষিত হয়েছিল।
ছোটবেলায় তার অসামান্য মেধা নিয়ে কিছু গল্প চালু আছে, যা তিনি তার কিছু আত্মজীবনীমূলক লেখায়ও লিখে যান। যেমন : বুখারায় যখন তিনি পড়তেন, তার বাবা চেষ্টা করতেন তাকে সেই সময়ে শহরের সেরা শিক্ষকদের দিয়ে পড়াতে। কিন্তু দেখা যেত, তিনি এতটাই মেধাবী ছিলেন, বেশির ভাগ শিক্ষকই তাকে পড়াতে পারতেন না। কারণ যে বিষয়ের ওপর পড়াতেন, কিছুদিন পর দেখা যেত, তিনি শিক্ষককে সেই বিষয়ের ওপর আরো বেশি পড়াচ্ছেন।
ইবনে সিনার পরিবার ছিল শিয়া ইসমাইলি সম্প্রদায়। যদিও এই ইসমাইলি সম্প্রদায় শিয়া বারোটি গ্রুপ থেকে একটু পৃথক। কিন্তু শিয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে ইসমাইলিরাই সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ছিল। ইসলামের অন্যতম একটি সময় এক হাজার থেকে বারো শ’ খ্রিষ্ট, এই সময়ে ইসমাইলিরাই ফাতেমিদ সাম্রাজ্য তৈরি করেন, যা আজকের উত্তর আফ্রিকা থেকে স্পেন পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। এক সময় আশির দশকে বাংলাদেশে যে আগা খান ফুটবল টুর্নামেন্ট হতো, তা স্পন্সর করতেন ইসমাইলি সম্প্রদায়ের প্রধান আগাখান চতুর্থ, যার পরিবার পাকিস্তান ও ইংল্যান্ডে বসবাস করেন।
ইবনে সিনা যখন বুখারায় পড়তেন, ইসলামের অন্যতম ফিকাহ শাস্ত্র হানাফি ফিকাহর বিশেষজ্ঞ ইসমাইল জাহিদের কাছে হানাফি ফিকাহ শাস্ত্রের ওপর শিক্ষা লাভ করতে গিয়ে হানাফি শাস্ত্রের অনুরাগী হয়ে শিয়া সম্প্রদায় থেকে বেরিয়ে সুন্নি হানাফি রীতি মেনে চলতেন।
মাত্র ১৫ বছর বয়সেই তিনি হানাফি শাস্ত্রের ওপর সর্বোচ্চ জ্ঞান লাভ করেন। অনেকের যা করতে দীর্ঘজীবন লেগে যেত, কৈশোরকাল তিনি এই বিষয়ে বিশেষজ্ঞ লাভের পরে সেখানেই থেমে থাকেননি। ঠিক করলেন চিকিৎসক হবেন। অল্পদিনেই তিনি চিকিৎসা শাস্ত্রের ওপর তরুণ বয়সে এতটাই অভিজ্ঞ হয়ে উঠলেন, তৎকালীন বুখারার সবচেয়ে জনপ্রিয় চিকিৎসক হিসেবে পরিচিতি পেলেন।
বুখারার আমির একবার খুব কঠিন রোগে পড়লেন। বুখারার সেরা ডাক্তার তার চিকিৎসায় ব্যর্থ হলেন। শেষে ইবনে সিনার চিকিৎসায় তিনি ভালো হয়ে উঠলেন। আমির খুব খুশি হয়ে ইবনে সিনাকে অনেক পুরস্কৃত করতে চাইলেন। জবাবে ইবনে সিনা বললেন, তার অনেক সোনা-রুপা মুদ্রার দরকার নেই, আমির যদি সদয় হয়, তিনি যদি তাকে আমিরের ব্যক্তিগত লাইব্রেরিটি ব্যবহার করতে সুযোগ দেন, সেটাকেই পুরস্কার হিসেবে গ্রহণ করে নেবেন। বুখারার আমিরের তৎকালীন লাইব্রেরিটি ছিল বাগদাদের পরে অন্যতম একটি সেরা লাইব্রেরি। কথিত আছে যে, ইবনে সিনার মেমোরি এত ভালো ছিল, তিনি লাইব্রেরির বেশির ভাগ বই একবার পড়েই মুখস্থ করে ফেলেছিলেন।
বুখারা আমির মারা যাওয়ার পরে বুখারে গৃহযুদ্ধ শুরু হলে ইবনে সিনা শহরটি ছেড়ে পাশের রাজ্যে তুর্কেমিনিস্তানে চলে যান। সেখানে প্রায় ১০ বছর ছিলেন।
ইবনে সিনা পারিবারিক শিয়া রীতি থেকে বেরিয়ে সুন্নি ও হানাফি ফিকাহ মেনে চলতন। জ্ঞান, গবেষণা, অধ্যয়ন, পর্যবেক্ষণ ইত্যাদির মধ্য দিয়ে অর্জিত উপলব্ধিকে আরো উচ্চতর ভাবতেন। তিনি সঙ্গীতের খুব ভক্ত ছিলেন, কবিদের খুব কদর করতেন, এমনকি নিজেও কাব্যচর্চা করতেন।
এই মহান চিকিৎসক এবং মনীষী জন্মেছেন উজবেকিস্তানে, মারা গেছেন ইরানে।


আরো সংবাদ



premium cement
ড. ইউনূসের ইউনেস্কো পুরস্কার নিয়ে যা বললেন তার আইনজীবী একনেকে ৮৪২৫ কোটি টাকার ১১ প্রকল্প অনুমোদন সান্তাহারে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে যুবক নিহত জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : আব্দুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রের সেতু ভাঙ্গার প্রভাব পড়বে বিশ্বজুড়ে! নাশকতার মামলায় চুয়াডাঙ্গা বিএনপি-জামায়াতের ৪৭ নেতাকর্মী কারাগারে হারল্যানের পণ্য কিনে লাখপতি হলেন ফাহিম-উর্বানা দম্পতি যাদের ফিতরা দেয়া যায় না ১৭ দিনের ছুটি পাচ্ছে জবি শিক্ষার্থীরা বেলাবতে অটোরিকশা উল্টে কাঠমিস্ত্রি নিহত রোহিঙ্গা ইস্যুতে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে জাতিসঙ্ঘের প্রতিবেদন

সকল