২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

কাফনে মোড়ানো অপেক্ষা

কাফনে মোড়ানো অপেক্ষা -

আজ মানতের নফল রোজা রাখার দিন ছিল। কোহিনূর রোজা ছিল সারাদিন। সন্ধ্যায় সে ইফতারে ছোট্ট আয়োজনের জন্য প্রস্তুত হলো। তার স্বামীর জন্য ইফতারের আগে দোয়া করল। স্বামী ওমর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছে। এক সপ্তাহ আগে, সে লোক মারফত চিঠি পাঠিয়ে জানিয়েছে যে, অবশ্যই যুদ্ধ শেষ করে জয় নিয়ে বাড়ি ফিরে আসবে। কোহিনূর মনের সুখে সব প্রস্তুতি নিচ্ছে। শাশুড়ি তাকে এত নফল রোজা রেখে শরীর কাহিল না করার ব্যাপারে তাগিদ দিচ্ছেন বারবার। গর্ভের সন্তানের ওপর এর প্রভাব পড়বে। কিন্তু স্বামী সুস্থ হয়ে ফিরে আসার জন্য শুধু নফল রোজা নয়, তার কাছে সারারাত জেগে নামাজ আদায় কম মনে হতে লাগল।
যুদ্ধ শেষ হয়নি। ওমর এখনো আসেনি। কোহিনূরের প্রসব সময়ও ঘনিয়ে আসছে। তার খুব টেনশন হতে লাগল। হঠাৎ লোক মারফত চিঠি এলো। খুলে দেখল ওমরের চিঠি। স্বামীর চিঠি হাতে পেয়ে তার প্রাণে প্রাণ এলো। চিঠিতে লেখা, কোহিনূর কেমন যাচ্ছে তোমাদের মা সন্তানের দিনগুলো? দুঃখিত কোহিনূর, যুদ্ধ শেষ না হওয়াতে আসতে পারলাম না। আসলে আমি একজন মুক্তিবাহিনী হয়ে দেশের জন্য তোমার কাছ থেকে ছুটি নিয়েছি। দেশ স্বাধীন করব। এই দেশ আমার স্বাধীন হবে। স্বাধীন করার ভারটা তাই আমার ওপর একটু বেশিই। দেশের মানুষের জন্য এখনো অনেক কাজ বাকি। পাকিস্তানি সেনারা এই বাংলায় হত্যা, বাড়িঘরে লুণ্ঠন ও আগুন দিয়ে বহু পরিবার ধ্বংস করেছে। অনেক জায়গায় মা-বোনেরা পাশবিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। হত্যাযজ্ঞ, নিপীড়ন-নির্যাতনে বিপর্যস্ত পুরো বাংলা। রণাঙ্গন, শরণার্থী শিবির ও দেশের ভেতরে থেকে যাওয়া মানুষ আতঙ্ক এবং জীবনের চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে এখন। বীর বাঙালি মাতৃভূমিকে দখলদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করতে লড়াইয়ে লিপ্ত আমরা।
প্লিজ কোহিনূর, আমার সন্তানের দিকে খেয়াল করো। কিছুদিন অপেক্ষা মাত্র, আমি অবশ্যই আসব। আমি খোলা আকাশের নিচে পাতার বিছানা বিছিয়েছি, ঘুমাব খানিক। শরীর অনেক ক্লান্ত। তোমার সাথে দেখা হলে প্রথমেই আমাকে এক থালা গরম ভাত ঝোলের সাথে এনে দেবে। বহুদিন মাছ ভাত খাই না আমি। একদিন পেট ভরে খুব খাবো। পরে চিঠি লিখব আবার।
চিঠি ভাঁজ করে রেখে কোহিনূর শাশুড়িকে খবর দিতে গেল। এবার তার মন শান্তি পেল।
এক মাস পর। কোহিনূর সব প্রস্তুতি নিয়েছে, ঘর সাজিয়েছে বরের মতো। সন্ধ্যায় রান্নার আয়োজন করা হয়। মনটা এদিক ওদিক দুলছে। সকাল থেকে সে ওমরের জন্য অপেক্ষা করছে। শাশুড়ি বারবার জিজ্ঞেস করেন, ওমর কখন আসবে?
কোহিনূর বলল, চিঠিতে তো জানিয়েছে আজকের তারিখ।
পরের দিন বিকেল হয়ে গেছে, এখন আর কোনো কাজ করতে ভালো লাগছে না কোহিনূরের। প্রতিবেশীর মুখে শুনল এলাকায় রাজাকার হামলা করেছে। চার জওয়ান শহিদ হয়েছেন, যুদ্ধ চলছে। খবর শুনে কোহিনূরের হাত পা কাঁপতে লাগল। দরজা জানালা বন্ধ করে বিছানায় চুপচাপ বসে থাকল। তার মনে খারাপ চিন্তা আসতে থাকে। এ বিষয়ে সে তার শাশুড়িকে কিছু জানায়নি।
হঠাৎ দরজায় শব্দ উঠল। উত্তেজনায় কোহিনূর জিজ্ঞেস করল, ওমর তুমি কি এসেছ?
দরজার ওপাশে কোনো উত্তর নেই, শুধু নীরবতা।
দরজা খুলে কোহিনূরের মন খারাপ হয়ে গেল। তারপর একটা আওয়াজ এলো, এসে দেখো! তোমার স্বামী কত বীরের মতো দেশের জন্য লড়াই করেছে!
কোহিনূর কেঁদে ওঠে। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার বললেন, কোহিনূর তোমাকে সাহস নিতে হবে, তুমি একজন শহীদ মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী! তোমাকে সাহসের সাথে প্রতিটা পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে হবে। বাইরে আসো, নিজেকে শক্ত করো।
কোহিনূর ধীরে ধীরে বাইরে এসে দরজায় দাঁড়াল। শহীদ ওমরের মরদেহ বাইরে পড়ে আছে, পলিথিন পেপারে মোড়ানো।

 


আরো সংবাদ



premium cement