২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

মানুষের জীবন ও বিজ্ঞান

-

(গত সংখ্যার পর )
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অন্য আরেকটি দিকও আছে। বিজ্ঞান জলে, স্থলে ও মহাশূন্যে বিরামহীন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে এবং নব নব অভিনব বিষয় আবিষ্কার করে মনুষ্য সমাজকে একের পর এক তাক লাগিয়ে দিচ্ছে! কোষ জীববিজ্ঞান এমন সব গবেষণা ও আবিষ্কার করে চলেছে যে, অনেকে এখন মনে করতে শুরু করেছেন, বিজ্ঞানের গতি অপ্রতিরোধ্য, শক্তি ও ক্ষমতা অসীম! তারা বলে থাকেন, ‘সে দিন আর বেশি দূরে নয়, যে দিন বিজ্ঞান মানুষকে অমর প্রাণীতে পরিণত করে দেবে। মানুষ আকাশযানে চড়ে গ্রহ থেকে গ্রহান্তরে ঘুরে বেড়াবে। পৃথিবী নামক এই সবুজ গ্রহের বাইরে গিয়ে বসতবাড়ি গড়বে ইত্যাদি ইত্যাদি। বিজ্ঞানের এমন সাফল্য মানুষের চিন্তাজগতকে প্রতিনিয়ত নতুনভাবে ঝাঁকুনি দিচ্ছে। ইদানীং বিজ্ঞানমনস্করা আরো ভাবতে শুরু করেছেন যে, বিজ্ঞান পারে না, এ জগতে এমন কিছু নেই। আজ হোক, কাল হোক, বিজ্ঞান মানুষের যাবতীয় সমস্যার সমাধান দেবে। মানুষের সব কৌতূহল ও সওয়ালের জবাব বের করে আনবে। মহাসৃষ্টির তামাম অজানা রহস্যের সব দুয়ার খুলে দেবে। এতক্ষণ যা বললাম, তা বিজ্ঞানের সাফল্য, বিজ্ঞানের অবদান এবং আগামী দিনে বিজ্ঞানকে নিয়ে মানুষের আশা-আকাক্সক্ষার কথা।
বিজ্ঞান প্রসঙ্গে এবার অন্য একটি বিষয়ের অবতারণা করতে চাই। প্রাণীজগৎসহ মহাবিশে^র সবখানেই ক্রমাগত পরিবর্তনের আলামত অতি সুস্পষ্ট। এ কথা বোঝার জন্য কাউকে বিজ্ঞানবিশেষজ্ঞ হতে হয় না। ক্রমাগত পরিবর্তনের এই ধারাবাহিকতাকে বিজ্ঞানের ভাষায় বিবর্তন বলে, বিবর্তনের সর্বজনীনতায়ও আমি কোনো সমস্যা দেখি না, তবে বিবর্তনের সর্বজনীনতার সাথে ‘বিবর্তনবাদের’ একটি বড় ফারাক আছে। ‘বিবর্তনবাদ’ একটি বিশেষ দার্শনিক মতবাদ যা এসেছে ডারউইনের ‘অরিজিন অফ স্পিসিস’ থেকে। এর একটি গভীর অন্তর্নিহিত ‘বাণী’, আছে। এই মূল বাণীটি হলো, মানুষ নিম্ন শ্রেণীর প্রাণী থেকে ‘বিবর্তিত’ হয়েছে এমন এক প্রক্রিয়ায়, যে প্রক্রিয়ায় বানর, বেবুন, শিম্পাঞ্জী, ওরাং-ওটাং ইত্যাদির উদ্ভব হয়েছে তাদের পূর্ব-প্রজাতি থেকেÑ পৃথিবী নামক আমাদের এই প্রিয় গ্রহে। মানুষের সাথে কথিত প্রজাতিগুলোর এত এত মিল খুঁজে পাওয়া যায় যে, যে কেউ মনে করতেই পারেন, ‘তাহলে বুঝি মানুষ এবং ওই প্রাইমেটগুলোর উৎপত্তির উৎস এক ও অভিন্ন’। ‘বিবর্তন’বাদীরা যুক্তি হিসেবে এ রকম বলতে পারেন, মানুষের মাঝে যেমন পশুর বৈশিষ্ট্য পাওয়া যায়, তেমনি কিছু কিছু পশু-প্রাণীও মানবিক গুণাগুণের অধিকারী। উদাহরণস্বরূপÑ মানুষ পশুর মতো খায় দায়, ঘুমায়, বংশবিস্তার করে, আবার প্রাণিকুলে মানবের মতো বুদ্ধিমত্তার অস্তিত্বও খুঁজে পাওয়া যায়, যেমনÑ পিঁপড়া, মৌমাছি ও বানরসহ আরো অনেকের বুদ্ধি আছে এবং তারা দলবদ্ধ হয়ে বসবাস করে। কুকুরের মাঝে আছে প্রগাঢ় প্রভুভক্তি ও আনুগত্যবোধ। প্রায় সব প্রাণীই মানুষের মতো বিপরীত লিঙ্গের প্রতি আকৃষ্ট হয়, পরবর্তী প্রজন্মের প্রতি তাদের মায়ামমতারও কমতি নেই। মানুষের মতো তারাও সুখে আন্দোলিত হয়, দুঃখ পেলে কাঁদে। পশুরও রাগ আছে, ক্ষোভ আছে, আবেগ আছে, আছে উচ্ছ্বাস। পশু হিংস্র হয়, মানুষ হিংস্রতায় পশুকে অহরহ হার মানায়। অতএব, তাদের মতে, মানুষ পশুরই এক উন্নত ও পরিশীলিত সংস্করণ। ‘বিবর্তনবাদ’ যদি সঠিক হয়ে থাকে, তাহলে সামনে এমন একদিন আসবে যখন মানুষ আর মানুষ থাকবে না, ‘অতিমানুষ’, ‘মহামানুষ’, ‘অধঃপতিত মানুষ’ কিংবা ‘অভিনব মানুষ’ নামে অন্য কোনো প্রজাতিতে রূপান্তরিত হয়ে যাবে এবং সেখানেও থেমে থাকবে না, এভাবে ক্রমাগত তার ক্রম ‘বিবর্তন’ হতেই থাকবে।
মানুষের সঙ্গে পশুর হাজারো মিল থাকতে পারে, কিন্তু তাদের মাঝে তিনটি মৌলিক পার্থক্য আছে। প্রথমত, পৃথিবীতে মানুষই একমাত্র প্রাণী যার চাহিদা সীমাহীন। পশু-পাখির চাহিদা তার পেট ভরাবার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, কিন্তু মানুষের চাহিদার কোনো চৌহদ্দি নেই। একটি বিশেষ সময়ে মানুষ একটি বিশেষ চাহিদা পূরণ করে ফেলতে পারে এবং এই পূরণ করে ফেলাটাই সঙ্গে সঙ্গে তার জন্য আরো হাজারো চাহিদার দুয়ার খুলে দেয়। এখানে লক্ষ করার মতো আরেকটি মজার ব্যাপার আছে। দুটো কঠিন বাস্তবতা নিরন্তর মানুষের এই ‘অসীম চাহিদা’র লাগাম টেনে ধরে রেখেছে। তার একটি বস্তুতান্ত্রিক এবং আরেকটি নৈতিক। এক. মানুষ যত বিত্তশালীই হোক না কেন, দিনের শেষে তার সম্পদ সীমিত। সীমিত সম্পদের কারণে সে তার সব চাহিদা মেটাতে পারে না। চাহিদার মাঝে তার জন্ম এবং অসংখ্য অপূর্ণ চাহিদা নিয়েই সে দুনিয়া থেকে বিদায় নেয়। প্রাণিকুলের বেলায়ও এ কথা সত্য। তাদের বেঁচে থাকার একমাত্র অবলম্বন খাদ্য ও পানীয়। তাদের জন্যও জগতে এ দুই বস্তুর জোগান সীমিত। দুই. মানুষ তার জীবনে এই সীমিত সম্পদ আহরণের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে আরো একটি কঠিন ও কঠোর বাস্তবতাকে সঙ্গে নিয়ে। এই বাস্তবতা আর কিছু নয় সমাজ, রাষ্ট্র ও রাষ্ট্রীয় আইন-আদালত, সর্বোপরি নিজের বিবেকের কাছে তার দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা।
(বাকি অংশ আগামী সংখ্যায়)


আরো সংবাদ



premium cement