২৩ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ছিন্নমূল জীবনে পথশিশুর কান্না

-

মায়ের কোলে যখন একটি শিশুর জন্ম হয়, সেই শিশুর পুলকিত মুখাবয়ব দেখে ভুবন ঝলমল করে উঠে। আঁধার টুটে উদিত হয় এক নতুন সূর্য। সেই ফুটফুটে শিশুটির জীবনেই একসময় নেমে আসে বিষাদের নীল ছায়া। তার জীবন যখন জনাকীর্ণ রাস্তায় নিপতিত হয়, তখন তার নামের শেষে যুক্ত হয় পথশিশু। আমার চোখে দেখা, রাজধানী শহরে বেশির ভাগ পথশিশু, অযতেœ, অনাদরে, অবহেলিত অবস্থায় ফুটপাথে পড়ে আছে। কখনো কখনো তাদের ময়লাযুক্ত কোমল দু’হাত বাড়িয়ে দেয় পথিকের দিকে। পেটে একটু খাবার দিতে কতই না কসরত! তাদের নয়ন তৃষ্ণার্থ, রাজ্যের ক্ষুধায় কাতর দৃষ্টি, ঘুম নামক প্রশান্তিটা তাদের কাছে স্বপ্নের মতো। কী করুণ সেই দৃশ্য! তাদের চাহনির মলিনতা দেখে যে কারোর নয়ন বেয়ে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে যাবে।
বাংলাদেশে পথশিশুর সংখ্যা ১০ লাখেরও অধিক, এর মধ্যে ৭৫ শতাংশ পথশিশু রাজধানীর অলিগলিতে ঘুরে বেড়ায়। বাংলাদেশের বেশির ভাগ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে। আর এই পথশিশুরা দরিদ্র পরিবারেরই একজন। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও নানান অভাব-অনটনের কারণে শিশুরা পথের পানে অগ্রসর হয়। তাদের জীবনে নেই কোনো নিরাপত্তা। নেই শিক্ষা গ্রহণের আগাম প্রস্তুতি।
নিত্যদিনই বেনোজলে ভেসে যায় কাক্সিক্ষত স্বপ্নের পাড়। রাজধানীতে যেসব পথশিশু রয়েছে তাদের মধ্যে ৮৫ শতাংশ পথশিশু মাদকের বিষাক্ত ছোবলে হারাচ্ছে মানসিক ভারসাম্য। অবাঞ্ছিত অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে হরহামেশায়। আবার এই ফুটফুটে পথশিশুরা নিষ্ঠুর মানুষের থাবায় নির্যাতিত হচ্ছে দিনের পর দিন। পথশিশুদের মধ্যে যারা নারী শিশু তাদের নিপীড়ন হতে হয় বেশি! রাস্তার অমানবিক ব্যক্তিদের চক্ষুশূল, তাদের খারাপ স্পর্শ নারী শিশুদের ওপর ভারী পাথরের মতো বর্ষণ হয়। পরিচিত হয় ‘ধর্ষণ’ নামক অপ্রত্যাশিত এই শব্দের সাথে!
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আগাছার মতো বেড়ে ওঠা এই পথশিশুরা, ছিন্নমূল জীবনের ভার কাঁধে নিতে কেউ হাতে তুলে নেয় কয়লা ভাঙার হাতুড়ি, কেউ চায়ের কেতলি, কেউ বা পত্রিকা, ফুল ইত্যাদি বিক্রি করে।
কম বয়সেই তারা আটকা পড়ে শ্রমের কঠিন শেকলে। রাজধানীতে ৫০ শতাংশ পথশিশু শ্রমের সাথে জড়িত। এত কম বয়সে কাজ করা তাদের কাছে অসাধ্য ব্যাপার। তবুও ক্লেশহীন একটি রঙিন জীবন পেতে তাদের অদম্য প্রচেষ্টা। রাজধানীতে ৪১ শতাংশ শিশুরই নেই ঘুমানোর আবাসস্থল। তারা বিভিন্ন জায়গায়, রাস্তার আশপাশে, স্টেশনের ধারে, ফুটপাথে খোলা আকাশের নিচে ঘুমায়। হাড় কাঁপানো শীতেও পায় না গরম কাপড়ের উষ্ণতা।
৮০ শতাংশ শিশু আহার জোগাড়ে জনসাধারণের কাজ করে থাকে। ৫৪ শতাংশ শিশুর অসুস্থতায় দেখার কেউ থাকে না। পথশিশুরা বিভিন্ন রোগে ভুগতে থাকেÑ জ্বর, সর্দি-কাশি, কলেরা, টাইফয়েড ইত্যাদি। অর্থসঙ্কটের কারণে ৭৫ শতাংশ শিশু চিকিৎসা করাতে ব্যর্থ হয়। বর্তমান করোনা পরিস্থিতিতে পথশিশুদের অবস্থা আরো বেশি বেগতিক। তিন বেলা আহার জোটাতে হিমশিম খাচ্ছে প্রতিনিয়ত। পুষ্টিহীনতায়ও ভুগছে এই শিশুরা।
নৈতিকতা, সভ্য আচরণ শেখার জন্য শিক্ষা একটি অপরিহার্য মৌলিক উপাদান। শিক্ষা ছাড়া পথশিশুদের উন্নতি সাধন কোনোভাবেই সম্ভব নয়। পথশিশুদের ফুলেল জীবন উপহার দিতে তাদের জন্য শিক্ষার অধিকার বাস্তবায়ন করা অতি জরুরি। সে জন্য, পথশিশুর মৌলিক চাহিদা পূরণ ও তাদের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে জাতিসঙ্ঘের অঙ্গসংগঠন ‘ইউনিসেফ’ শিশুদের মাথার ওপর ছাতার মতো দারুণ ভূমিকা পালন করে আসছে। মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তত্ত্বাবধানে প্রায় ৪০ হাজার সুবিধাবঞ্চিত শিশুকে শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার জন্য কঠোর উদ্যমে কাজ করছে তারা। শিশু সুরক্ষা প্রকল্প থেকে, শিশুদের সুরক্ষা ও সুস্বাস্থ্য নিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদফতরের মাধ্যমে দু’টি পৃথক প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। প্রকল্পগুলোর একটিÑ চাইল্ড সেনসিটিভ সোশ্যাল প্রোটেকশন ইন বাংলাদেশ (সিএসপিবি) এবং অপরটিÑ সার্ভিসেস ফর দ্য চিলড্রেন এট রিস্ক।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন একটি বাংলাদেশী স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এখানে অসহায় শিশুদের, আহার-নিদ্রা, শিক্ষা, বিনোদন, চিকিৎসা এবং আইনসেবা প্রদান করে। এ ছাড়া বাংলাদেশে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সংস্থা রয়েছে যারা পথশিশুদের নিয়ে নিয়মিত কাজ করছে।
একটি শিশু আগামীর উজ্জ্বল নক্ষত্র। সেই প্রত্যয়ে আমাদের শিশুদের গড়ে তুলতে হবে। সরকারিভাবে তাদের জন্য আরো বেশি সুবিধার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারে কাছে আমাদের বিনীত আবেদন। পথশিশুকে পথের গলি থেকে ফিরিয়ে তাদের হাতে তুলে দেবো বই-খাতা-কলম। সুযোগ করে দেবো রঙিন স্বপ্ন দেখার। সেই স্বপ্ন হবে আগামীর স্বপ্ন। বড় হওয়ার স্বপ্ন। পৃথিবী আলোকিত করার স্বপ্ন।


আরো সংবাদ



premium cement