২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাবা

-

হেমন্তের শেষ বিকেল। আকাশে পাতাঝরা দিনের বিষণœতার আনাগোনা। মন খারাপ করা বিকেল দ্রুত ফুরিয়ে শহরজুড়ে নেমে আসছে উদাসীন সন্ধ্যা। কুয়াশাভেজা শীতের আগমনী বার্তা জানান দিচ্ছে। বৃষ্টি নেই, কিন্তু বাতাসে জলের গন্ধ রয়েছে। কোথা থেকে এসেছে এত জল? হাসপাতালের দেয়ালে কান পাতলে হয়তো উত্তর মিলবে কিছুটা। প্রিয়জন হারানোর নোনাজলে সিক্ত চারপাশ। ভঙ্গুর হৃদয়ে উতালপাথাল ঝড় বইছে আমার। সকাল থেকে জিইয়ে থাকা গুমোট ভাবটা পাথরচাপা বুকে ক্রমে প্রকট হতে থাকে। আজ বাবার অবস্থা ভালো না। মনে কু ডাক দিচ্ছে কিছুক্ষণ পরপর। যেকোনো মুহূর্তে যেকোনো অনর্থক ঘটনা ঘটে যেতে পারে। ডাক্তার, নার্স ও সিস্টারদের ব্যতিব্যস্ততা খারাপ কিছুর দিকে ইঙ্গিত দিচ্ছে। সকাল থেকে আজ একবারও কোত্থাও বের হওয়ার চেষ্টা করিনি। এ দিকে একটু পরপর ফোন বেজে উঠছে। আত্মীয়স্বজনদের সবার আগ্রহের কেন্দ্রে আমার বাবা। সবাই একটু ভালো খবর শুনতে চায়। অনিচ্ছা সত্ত্বেও বেশির ভাগই ইগনর করছি। স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখি বেবি আপার ফোন। ফেরদৌসী আক্তার বেবি। এই একটি মাত্র মানুষটাকে ইগনর করার সাধ্য নেই আমার। অবহেলা করা যায় না। বেবি আপা আমার আপন বড় বোন। এই দুঃসময়ে থাকা সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য আপনজন। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে আপার চাপাস্বর ও উদ্বেগ ভেসে আসে, ‘কি রে দুপুর গড়িয়ে বিকেল যায়, তুই খাবি কখন? গোসল করবি না? আয়, জলদি ফ্রেশ হয়ে খেয়ে যা। এভাবে চলতে থাকলে যেকোনো মুহূর্তে পড়ে যাবি তো। নিজের সর্বনাশ আর করিস না। আয় আয় জলদি খেতে আয়। আপা তোর জন্য বসে আছি।’ আমি কোনো মতে আমতা আমতা করে বলি, ‘জি আপা, আমি এক্ষুণি আসছি, এই তো আরেকটু...।’ আপার একনাগাড়ে বলে যাওয়া কথাগুলো আমার কানে ঢুকে না, মাথার উপর দিয়ে যায়। হাসপাতালের প্রায় ২০০ গজের ভেতর বেবি আপার সুন্দর পাঁচতলা বাসাটি অবস্থিত। বাবার বেড থেকে জানালার কাচ গলিয়ে পূর্বদিকে তাকালে মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সুরম্য বাসাটি স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়। যেতে-আসতে মাত্র মিনিট দশেকের পথ। অথচ তবুও মনে হয় কত সুদীর্ঘ পথ। পথের মাঝে আরো কত শত পথ! এ পথ যেন সহজে শেষ হওয়ার নয়। যাব যাব করেও আজ আর যাওয়া হলো না। বাবা নামের বটবৃক্ষটাকে আড়াল করতে মন কিছুতেই সায় দিচ্ছিল না। বাবার পাশে চুপচাপ বসে আছি। গত চার দিন চার রাত ঘুমহীন চোখে বাবাকে এভাবেই পাহারা দিয়ে যাচ্ছি। সেবাশুশ্রƒষা করে যাচ্ছি ক্লান্তিহীন। বাবাকে প্রায় বলতাম, ‘বাবা রাতের ২টা হোক কিংবা ৪টাÑ চোখ মেলে আমাকে সবসময় পাশে দেখতে পাবে। তুমি চিন্তা করো না, আমি আছি। মনে মনে আল্লাহকে স্মরণ করো, নিশ্চয় শান্তি পাবে।’ আমার সামান্য কয়েকটি কথাতে বাবা আশ্বস্ত হতেন, ভরসা পেতেন। পরম নির্ভরতায় চোখ বুঝে চোখের লবণজল ফেলতেন। এ দিকে আরেকজন মানুষের কথা না বললেই নয়। আমার শ্রদ্ধেয় আপন বড় ভাই মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন। হাসপাতালের প্রথম দিন থেকে রোবটের মতো চলছে ভাইয়ের বিক্ষিপ্ত ছোটাছুটি। ঢাকা টু কুমিল্লøা। আটতলা থেকে নিচতলা, হাসপাতালের এ মাথা থেকে ও মাথা। নিরন্তর চষে বেড়াচ্ছেন। এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে টানা দৌড়ঝাঁপ। প্রত্যেকে যেন একটি ঘোরের মধ্যে আছি। সময় কখন বয়ে যায়, বুঝতে পারি না। রাত ৮টার পর থেকে বাবার অবস্থা আরো খারাপ হতে থাকে। শ্বাস-প্রশ্বাস ক্রমে বাড়তে থাকে, শরীরে খিঁচুনি উঠে আশঙ্কাজনকভাবে। সকাল থেকে বাবাকে অক্সিজেন দেয়া হয়েছে, তারপরও এখন হঠাৎ অক্সিজেন লেবেল সেকেন্ডের গতিতে হ্রাস পেতে থাকে। উ™£ান্ত পাগলের মতো আমরা হাতেগোনা কয়েকজন মানুষ ছোটাছুটি করতে থাকি। এরই মধ্যে দ্রুতগতিতে বেবি আপা চলে আসেন হাসপাতালে। সকালে বাবাকে হাসপাতালে দেখতে আসা অসুস্থ মাকে সামলাতে তিনি ব্যস্ত হয়ে পড়েন। ডাক্তারের নির্দেশনা তামিলে ব্যস্ত বড় ভাই লিফটের অপেক্ষায় না থেকে পাগলের মতো সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত নিচে যান। ফার্মেসিতে এটা খোঁজে ওটা খোঁজে। এদিকে বাবার মাথা কোলে নিয়ে অনবরত কালিমা শাহাদাতের তালকিন দিয়ে যাচ্ছি আমি। চোখ রাখছি বাবার হাতের আঙ্গুলে রাখা অক্সিমিটারের দিকে। দেখি ৯০ থেকে নামতে নামতে ৩৫শে নেমে পড়ে। বলতে না বলতে পনেরো-দশ। তারপর ৯ আট সাত...! আরো উচ্চস্বরে কালিমার তালকিন দিতে থাকি। আহা রে (!) বাবা চলে যাচ্ছেন...। দুনিয়ার সমস্ত মায়ার বাঁধন, ব্যস্ততা ছিন্ন করে অভিমানী বাবা পাড়ি জমাচ্ছেন ওপারে। বাবার চোখেমুখে চুমুতে চুমুতে ভরে দিতে থাকি। রাত ৯টা বাজে তখন। হঠাৎ এক মুহূর্তের জন্য বাবা চোখ দুটি মেলে তাকান আমার দিকে। তারপর একদম চুপ। কোনো সাড়াশব্দ নেই। নেই কোনো প্রাণের স্পন্দন। চিরতরের জন্য নিথর, নিশ্চুপ ও স্তব্ধ হয়ে যান। বাবা আর নেই। একদম নেই। আমার বটবৃক্ষ বাবা আর নেই। যিনি আমার জন্ম থেকে তার শীতল ছায়া দিয়ে বড় করেছেন। এখন গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে আমার গা পুড়ে ছারখার হবে। দগ্ধ ক্ষতবিক্ষত হবে। কেউ আর বটবৃক্ষের ছায়া নিয়ে আমার পাশে এসে দাঁড়াবে না। কেউ না। আমি প্রখর সূর্যের তেজে মোমের মতো গলে গলে নিঃশেষ হয়ে যাব ধীরে ধীরে।

 


আরো সংবাদ



premium cement