২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

স্মৃতির গবাক্ষ ভালোবাসার ফুল

-

তখন আমি পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ছি মাত্র। সকালে ঘুম থেকে উঠে বারান্দায় গিয়ে আড়মোড়া ভাঙা ছিল নিত্য অভ্যাস। ফুরফুরে বাতাসে শ্বাস নেয়া ছিল দারুণ মুগ্ধতার। সেদিন সেই মুগ্ধতার সাথে আরেকটি প্রাপ্তি যোগ হলো- একটি স্নিগ্ধ মিষ্টি ঘ্রাণ। বাগানের দিকে তাকিয়ে দেখি একথোকা দোলনচাঁপা ফুল ফুটে আছে। দুলছে মৃদু বাতাসে। রাতের বৃষ্টিতে ভেজা বাগান। ফুলগুলোও যে সদ্যস্নাত বোঝাই যাচ্ছিল। সেই শিশুমনে সে কি দাগ কেটেছিল সেই ক্ষণে জানি না। আমি প্রাণভরে ঘ্রাণ শুঁকলাম। ভীষণ ভালো লাগছিল। বাগানটি ছিল ঠিক বারান্দা লাগোয়া কিন্তু প্রবেশ করতে হলে যেতে হতো মেইন দরজা খুলে বাইরে দিয়ে। ফলে বারান্দায় দাঁড়িয়েই উপভোগ করলাম কিছুক্ষণ।
বাগানটি ছিল আমাদের দু’ভাইবোনের যত্নে গড়া। মূলত আম্মা আর ভাইজানই এর উদ্যোক্তা। আমি ছিলাম হেল্পার। তবে যত্নে অন্তরাত্মা। খুবই সখের এ বাগান। সকাল-বিকাল দুবেলা বাগানের পাশে না গেলেই নয়। ভাইজান প্রায়ই দুটি বোতাম ফুল এনে আমার কানে পরিয়ে দিতেন সযত্নে। সে সময় গন্ধহীন হলেও বোতাম ফুলের উজ্জ্বল বেগুনি রঙ আমায় অভিভূত করত। এমনি অভিভূত হতাম আরো অনেক ফুলের গন্ধে-রঙে। কারণ আমাদের সে ছোট্ট বাগানটিতে বারো মাসই ফুল ফুটে থাকত। ভাইজান সেভাবেই বাগানটি সাজিয়েছিলেন। বাগানের নানা রকম ফুলের পাশে দোলনচাঁপার গাছটিও এক কোণায় বেড়ে উঠছিল স্ব-আভিজাত্যে। আর তার স্বীকৃতি সেদিনই সে প্রথম মেলে ধরেছিল।
যথারীতি দৈনন্দিন রুটিন অনুযায়ী প্রাতঃকালীন সব কাজ সেরে স্কুলের জন্য তৈরি হয়ে গেলাম। সময়মতো স্কুলবাস চলে এলো। আজ আর বন্ধুদের মাঝে না বসে একটু নিরিবিলি কোণ বেছে নিয়ে বসলাম। হৃদয়ে ভাসছে দোলনচাঁপা। একপর্যায়ে কলম বের করে ক্লাসের রাফ খাতাতে লিখে ফেললাম- ‘দোলনচাপা দোলনচাঁপা ভারি মিষ্টি মেয়ে, সারা দিন শুধু থাকো আকাশ পানে চেয়ে।’ সেদিন বুঝিনি এটিই যে হয়ে যাবে আমার কাব্য লেখার হাতেখড়ি। হঠাৎ বান্ধবীদের কৌতূহল এড়াতে খাতাটি লুকানোর বৃথা চেষ্টায় মেতে উঠলাম- ওদেরও জেদ চেপে গেল যেন। নাছোড়বান্দা হয়েই ওরা ছিনিয়ে নিয়ে পড়ে ফেলল হইহই শব্দে। আমার সে কি লজ্জা। রাও উঠে গেল- নূরন কবিতা লিখেছে, কবিতা লিখেছে। উঁহ কবি হয়েছে কবি হয়েছে। আহারে কোথায় পালাই আমি। কুমারী মেয়ের অবাঞ্ছিত প্রসবের মতো বিড়ম্বনাকর। ভেংচি কেটেই ওরা খুব মুখে মুখে আওড়াতে লাগল।
ধরা পড়ে গেলাম সান্ধ্যকালীন পড়ার টেবিলেও। সেদিন কি হয়েছিল কি জানি! হৃদয়ের কথন-নবজাতকের মুখখানি দেখার মতো বারবার খাতার পাতা উল্টে দেখছিলাম। পাঠে যে মনোযোগ নেই তা আর এড়ালো না ভাইজানের চোখে। হঠাৎ টানমেরে খাতাটি হাতে নিয়ে জোরে জোরে পড়লেন, দোলনচাঁপা দোলনচাঁপা, ভারি মিষ্টি মেয়ে, ... আমি তো কেঁদেই ফেলছি প্রায়। কি অপরাধ যে করলাম। চোখ ঝাপসা হয়ে গেছে, নাক চুয়ে তপ্ত জল বেরিয়ে পড়ছে তার মাঝে আওয়াজ এলো- আম্মা দেখেন নূরন কবিতা লিখেছে, ফুলকে বানিয়ে দিয়েছে মেয়ে। আমার সে কি লজ্জা! হায় লুকাবো কোথায়!
ভাইজানের চিৎকারে আম্মা-আব্বা-আপা সবাই এসে গেছেন, দেখলেনও। মুখটিপে হেসে সরেও গেলেন যে যার মতো। শুধু আমার সাহিত্যামোদি মা মিষ্টিস্বরে বললেন, ‘কবির চোখে ফুল তো মেয়ে হতেই পারে!’ মনে হলো এ টুকুই বুঝি আমার অপরাধ ছিল- যাক আমি বেঁচে গেলাম বুঝি। আর সেদিন থেকে দোলনচাঁপাই হয়ে গেল আমার ভালোবাসার ফুল।
ফুটবলপ্রেমী আমার ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা’ খেলোয়াড় ভাইজান সেদিন কবিতার মর্ম না বুঝলেও শিল্পী সুলভ ‘মা’ আমার ঠিক ধরেছিলেন মেয়ের সুপ্ত প্রতিভার রাঙারশি। নাচ-গান-অভিনয়ের পাশাপাশি আরো একটা যোগ হলো লেখালেখি। তৎকালীন জাতীয় শিশুকিশোর সংগঠন কচিকাঁচার মেলার অন্যতম সদস্য হিসেবে পরিচিতি পেতে বেশি সময় লাগেনি। পরপর পুরস্কারের থলে পূর্ণ হতে থাকল গুণীজনদের হাত দিয়ে। বেগম সুফিয়া কামাল, দাদাভাই রোকনুজ্জামান খান, বিজ্ঞানী ড. আবদুল্লাহ আল মুতী শরফুদ্দীনের মতো বিদগ্ধজনদের কাছ থেকে প্রশংসার সার্টিফিকেটও কুড়ালাম অনেক। কবিতা ও ছোটগল্প লেখা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে পুরস্কৃত হলাম যথাক্রমে বেগম সুফিয়া কামালের ‘বাসন্তী’ ও দাদাভাই সম্পাদিত ‘ঝিকিমিকি’ গল্পসমগ্রটি হাতে পেয়ে। এর পরবছরই ১৯৭১ সালের মার্চ থেকেই শুরু হয়ে গেল আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধ। যুদ্ধের বিভীষিকাময় তাণ্ডবে হারিয়ে গেল ভাইজানসহ আমার সব কীর্তিময় স্বীকৃতি। শুধু রয়ে গেল প্রকৃতির ফুল দোলনচাঁপা।
আজো বেলকনির কোণে দোলনচাঁপার রূপ-গন্ধ আমায় হারিয়ে ফেলে নস্টালজিয়ায়। শরৎ এলেই মেতে উঠি ওর খেলায়। কলম চলে দ্বিগুণ-ত্রিগুণ। সেই যে আমার প্রথম ভালোবাসা- আমার আগামীর পথচলার ভিত!


আরো সংবাদ



premium cement