১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ক্ষণিকের অতিথি

-

শ্রাবণের রাত। বাইরে আকাশ ভেঙে ঘোরতর বর্ষণ হচ্ছে। বর্ষণের শব্দে অমিতের ঘুম ভেঙে গেছে। সারা ঘরময় বিদঘুটে অন্ধকার। বিন্দুমাত্র আলোর উৎস নেই। লোডশেডিং হয়েছে। অমিত টর্চ লাইটটি জ্বেলে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলÑ ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় ২টা বাজে। এত রাতে ঘুম ভাঙাতে অমিতের মোটেও ভালো লাগছে না। তার কাছে ব্যাপারটা অসহ্য লাগছে।
হঠাৎ করেই বাইরে থেকে কে যেন অমিতের দরজায় কড়া নাড়ল। অমিত দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ শুনে চুপ হয়ে বসে আছে। সে ভাবলÑ এত রাতে আবার কে এলো! পরক্ষণে ভাবলÑ হয়তো কেউ আসেনি। তার মনের ভুল। কিন্তু খানিক বাদে আবারো দরজায় শব্দ হলো! এবার বাইরে থেকে কেউ একজন বললÑ ‘ভেতরে কেউ আছেন? দরজাটি খুলুন। আমি বেশ বিপদে পড়ে এসেছি।’ অমিত স্পষ্টত কথাগুলো শুনেছে। গলার স্বরটি কোনো পুরুষ মানুষের নয়; মেয়ে মানুষের। এত রাতে অমিত দরজায় মেয়েলি কণ্ঠস্বর শুনে হতভম্ব হয়ে গেল। এত রাতে একটি মেয়ে তার কাছে কী চায়? অমিত সাহস সঞ্চয় করে টর্চ লাইটটি জ্বেলে বিছানা ছেড়ে উঠে দরজার কাছে ধীর পায়ে এগিয়ে গেল। অমিত দরজার কাছে যাওয়ার পর মেয়েটি পুনরায় বলে উঠলÑ ‘ভেতরে কেউ আছেন? প্লিজÑ দরজাটি খুলুন।’ আমি বড় বিপদে পড়ে এসেছি। এবার অমিত আর চুপ করে থাকতে পারল না। সে গলা খাঁকারি দিয়ে বললÑ ‘কে এখানে?’ দরজার ওপাশ থেকে মেয়েটি বললÑ ‘আমার নাম নবনী। শহর থেকে এসেছি।’
‘এত রাতে কোথায় এসেছেন?’
‘আমি সফদার আলীর বাসায় যাব।’
‘এত রাত করে কে আসে? আর এটা তো সফদার আলীর বাসা না।’
‘আমি জানি। আমার ট্রেনটি গ্রায় ৩ ঘণ্টা একটি স্টেশনে আটকা পড়েছিল। তাই আমার এই স্টেশনে নামতে রাত হয়ে গেল।’
‘এখন আমি কী করতে পারি আপনার জন্য?’
‘আজকের রাতটুকু যদি আশ্রয় দিতেন তাহলে বেশ উপকার হতো। বুঝতেই পারছেন এত রাত করে একা একটা মেয়ে মানুষ আমি। আর সফদার আলীর বাসাটাও আমি চিনি না।’
অমিত কঠিন বিপাকের মধ্যে পড়ে গেল। সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছু বলছে না। এত রাত করে একটা অচেনা মেয়েকে কী ঘরের ভেতর আনা যায়? অপরদিকে মেয়েটি বিপদে পড়ে এসেছে। তাকে উপকার না করেই কী পারা যায়? মানবতা বলতে কিছু একটা এই পৃথিবীতে আজো আছে তো। অমিত খানিক ভেবেচিন্তে নিয়ে বললÑ ‘আমায় ক্ষমা করবেন। যদিও কাজটা আমার ঠিক হচ্ছে নাÑ তবুও একটা মেয়েকে তো এত রাত করে ঘরে আশ্রয় দিতে পারি না। এ খবর দশের কানে গেলে ভীষণ বিপদ হয়ে যাবে।’ মেয়েটি দরজার ওপাশ থেকে ক্লান্ত এবং পরাজিত কণ্ঠে বললÑ ‘তাহলে আপনি আমাকে আশ্রয় দেবেন না।’
‘আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি চাইলেও দিতে পারছি না।’
পরের দিন সকালবেলা অমিত দরজা খোলা মাত্রই অবাক হয়ে গেল! সে দেখলÑ তার দরজার বাইরে একটি মেয়ে শুয়ে আছে। তার শরীরের কাপড় ভিজে চুপসে আছে। এই মেয়েটিই গত রাতে অমিতের কাছে আশ্রয় চেয়েছিল। অথচ অমিত মেয়েটিকে আশ্রয় দেয়নি। অমিত মেয়েটিকে ডেকে ঘুম থেকে উঠিয়ে বললÑ ‘আপনি তাহলে গত রাতে যাননি? এখানেই শুয়ে ছিলেন?’ মেয়েটি বললÑ ‘হ্যাঁ। এমনিতেই রাত। তার মধ্যে এ গ্রাম আমার কাছে অচেনা। স্টেশন থেকে খানিক হেঁটেই প্রথমে আপনার বাসা দেখে ঢুকে পড়লাম।’
‘এত অন্ধকারের মধ্যেও কীভাবে দেখলেন?’
‘সাথে ছোট একটি লাইট ছিল।’
অমিত মেয়েটির সামনে বেশ লজ্জা অনুভব করল। অমিত বললÑ ‘ভেতরে আসুন।’ মেয়েটি বললÑ ‘না, ধন্যবাদ।’
‘রাগ করেছেন বুঝি?’
‘সফদার আলীর বাসাটি কোথায় বলতে পারবেন?’
‘হ্যাঁ, পারব। রাস্তায় গিয়ে যেকোনো রিকশাওয়ালাকে বললেই নিয়ে যাবে।’
‘ধন্যবাদ। আর শুনুন, আমি রাগ করিনি আপনার উপর।’
কথাটি বলেই মেয়েটি চলে গেল। অমিত মেয়েটির দিকে তাকিয়ে আছে। সে মেয়েটিকে কী বলবে? কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। কেবল তার মনে হতে লাগলÑ মেয়েটি হয়তো তার ক্ষণিকের অতিথি হয়ে এসেছিল। অথচ সে তার অচেনা এই অতিথিকে আপ্যায়ন করতে পারেনি। একজন বিপদগ্রস্ত মেয়েকে বৃষ্টির রাতে সাহায্য করতে না পারার আক্ষেপটি অমিতের বুকের ভেতর কাঁটা হয়ে বিঁধে রইল।


আরো সংবাদ



premium cement