২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দৃষ্টি যতদূর যায় সবুজ আর সবুজ

-

শরতের বিকেলে বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে ছিলাম পাহাড় ভ্রমণে। দুপুর-বিকেলের মাঝামাঝি সময়ে মাদরাসা থেকে বেরিয়ে মাইল দু’য়েক উত্তর দিকে গেলেই আনিস খাল। খালের পাড় ঘেঁষে সোজা পশ্চিম দিকে হাঁটছি বন্ধু জুবায়ের ভাই, হুসাইন, সাঈদ, ফাহিম আর আমি। জুবায়ের ভাই ইতোমধ্যে গরিবের ইবনে বতুতার খেতাব পাওয়ার দোরগড়ায়। ভ্রমণের প্রতি তার হৃদয়ের টান আমাকে ঈর্ষান্বিত করে। ভ্রমণপিয়াসী মানুষদের দেখলেও ভালো লাগে। খালের পাড় ঘেঁষে বিভিন্ন গাছগাছালির সমারোহ। সবুজের সজীবতা আর দক্ষিণ থেকে ধেয়ে আসা ধমকা হওয়া আমাদের তনুমনে আনন্দের হিল্লোল তুলে দিচ্ছে। মিনিট সাতেক হাঁটার পরেই সবুজের বুকে ধবধবে সাদা কোমল, মসৃণ কাশফুল আমাদের প্রবলভাবে আকর্ষিত করল। কাশফুলে ঘ্রাণ নেই। নেই কোনো আলাদা বৈশিষ্ট্য। কিন্তু কাশফুল দেখে কারো হৃদয়ে আনন্দের হিল্লেøাল বয়ে যায় না এমন হয়তো হয় না। কাশফুলের আলতো ছোঁয়া আমাদের মনে করিয়ে দিলো এখন শরৎকাল। আর শরৎকাল মানেই নীল শরতের বিকেলে মনকে প্রফুল্লø করতে কাশবনে গিয়ে কাশফুলের নরম ছোঁয়ায় এক স্নিগ্ধ বিকেল কাটাতে এবং জীবনের নানান ব্যস্ততার ফাঁকে একটু শান্তির খোঁজে কাশবনে ঘুরতে কার না ভালো লাগবে। কাশফুল কবি-সাহিত্যিকদের আকর্ষিত করে তাদের গদ্য-পদ্য স্থান করে নিয়েছে। কবি রবি ঠাকুরের ঐতিহাসিক কবিতা ‘আমাদের ছোট নদী’তে। প্রকৃতির পরিচিতও পাই আমরা এই ছড়া থেকে। তাই তো কাশফুলে আলতো ছোঁয়ায় মুখ থেকে বেরিয়ে এলো, ‘চিক চিক করে বালি, কোথা নাই কাদা/একধারে কাশবন ফুলে ফুলে সাদা। অনেকে তো আবার শরতের কাশফুলকে প্রেয়সীর সাথেও তুলনা করেছে। মহাকবি কালিদাস ‘ঋতুসংহার’ কাব্যে লিখেছেন ‘কাশ ফুলের মতো যার পরিধান/প্রফুল্লø পদ্মের মতো যার মুখ/ উন্মত্ত হাঁসের ডাকের মতো রমণীয় যার নূপুরের শব্দ/পাকা শালি ধানের মতো সুন্দর যার ক্ষীণ দেহলতা/অপরূপ যার আকৃতি সেই নববধূর মতো শরৎকাল আসে।’ কিন্তু সেই কাশফুল ক্রমশ কমছে প্রকৃতি থেকে। আগের চেয়ে অনেক নি®প্রভ কাশের অবাধ বিচরণ।
কাশফুলের আরো বেশি অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে আমরা পাহাড়ের দিকে চলে গেলাম। এগুলোকে ঠিক পাহাড় বলারও উপায় নেই। পাহাড় দস্যুদের হিংসাত্মক আগ্রাসনের শিকারে ক্ষত-বিক্ষত পাহাড়ের বুক। পাহাড় কেটে সমতল করে আবার অনেক জায়গায় পাহাড়ি গাছ কেটে বিরান ভূমিতে পরিণত করেছে। পাহাড় রক্ষা আইন আছে আমাদের দেশে। প্রতি বছর বাজেটও হয় সমানতালে। কিন্তু পাহাড় দস্যুদের দৌরাত্ম্য কমে না কোনো অংশে। স্থানীয় প্রভাবশালী নেতাদের দাপট ও হিংস্রতায় পাহাড় হারায় তার স্বকীয়তা। পাহাড়ের বুকে ছোট ছোট ঝুপড়ি ঘরে অনেকের বসবাস নজরে এলো। তবে এদের পাহাড়ি বলার সুযোগ নেই। কিছু দূর যেতেই চোখে পড়ল দৃষ্টিনন্দন মসজিদ। আসরের সালাত মাদরাসা সংলগ্ন মাসজিদেই আদায় করলাম। মসজিদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায় শুধু সবুজে ঘেরা উঁচু-নিচু পাহাড় চোখে পড়ে। পাহাড়ের বিশালতা, স্থীরতা আমাদের ঈমানের দিকে টানে। আল্লøাহ অসংখ্য সৃষ্টির অপরূপ সৌন্দর্য এই পাহাড়। কুরআনে আল্লøাহ তায়ালা পাহাড়ের কথা উল্লেখ করে বান্দাকে ঈমানের দাওয়াত দিয়েছেন। সূরা নাবার ৭ নম্বর আয়াতে আল্লøাহ বলেন, ‘এবং পর্বতসমূহকে কীলক রূপে নির্মাণ করিনি?’ সূরা গাশিয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘এবং পর্বতমালার দিকে (লক্ষ্য করো) যে কিভাবে ওটা দৃঢ়ভাবে স্থাপন করা হয়েছে?’ জুবায়ের ভাইকে বললাম, প্রকৃতির দিকে তাকিয়ে থাকুন। গভীর দৃষ্টি দিন। হৃদয়ের চোখে দেখুন। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করুন। প্রকৃতি এতটাই গুরুত্বপূর্ণ যে, প্রকৃতি মানুষ ছাড়া বাঁচতে পারে কিন্তুমানুষ প্রকৃতি ছাড়া বাঁচতে পারে না। তাই মাঝে মাঝে প্রকৃতির নির্মল সজীবতায় নিজেকে হারাতে ছুটে বেড়ান। মানুষের প্রতি প্রকৃতির দয়া ও ভালোবাসার কোনো তুলনা নেই। প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য সত্যি মনোমুগ্ধকর। আল্লøাহ তায়ালা প্রকৃতির কথা পবিত্র কুরআনেও ইরশাদ করেছেন, ‘স্থাপন করেছি পর্বতমালা এবং তাতে উদগত করেছি নয়ন প্রীতিকর সর্বপ্রকার উদ্ভিদ। আল্লাহর অনুরাগী প্রত্যেক ব্যক্তির জন্য জ্ঞান ও উপদেশ স্বরূপ।’
পাহাড়ের বুক চিরে ছুটে আসা ঝরনা পাইনি, তবে মাদরাসার পাশে ছোট আকারে একটি অগভীর দীঘি পেয়েছি। দীঘির মাঝে ছোট্ট একটি ডিঙি নৌকাও পেলাম। আমরা উঠে গেলাম নৌকায়। সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে তার তর্জন-গর্জন শুনতে পারিনি তবে হৃদয়ে সাগরের কল্পনা এঁকে সবাইকে বললাম, এই ছোট্ট দীঘিকে মনের আয়নায় সাগরে রূপান্তর করুন। এবার গভীর দৃষ্টিতে সাগরের দিকে তাকান। সাগর থেকে শিক্ষা নিন। নদীগুলো কিভাবে সাগরে আর সাগর কিভাবে মহাসাগরের সাথে মিলিত হয়েছে। আল্লøাহ কুরআনে বলেছেন, তিনি প্রবাহিত করেন দুই দরিয়া, যারা পরস্পর মিলিত হয়। নৌকায় বসে আকাশের সৌন্দর্য উপভোগ করতে গিয়ে বললাম, আকাশের দিকে তাকান। দেখুন আল্লøাহ কত সুন্দর একটি ছাদ আমাদের জন্য খুঁটিহীন তৈরি করে রেখেছেন এবং আল্লøাহ বলেছেন, তিনি আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন মানদণ্ড। আর নির্মাণ করেছি তোমাদের ঊর্ধ্বদেশে সুদৃঢ় সপ্ত আকাশ। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। দিনের তেজোদীপ্ত সূর্যটা ক্লান্ত ও নিস্তেজ হয়ে রক্তবর্ণ ধারণ করে পূর্বাকাশে নেতিয়ে পড়ছে। পশ্চিমের লালিমা পরিবেশকে আর রোমাঞ্চকর করে তুলছে। পাহাড় চড়তে গিয়ে হরেকরকম ফলমূলের দেখা মিলল। পাহাড়ে বসবাসরত ব্যক্তিরা এগুলো মালিকানা দাবি করছে। পরিচর্যাও করছে অনেকে।
ইতোমধ্যে মাগরিবের আজানের ধ্বনি ভেসে এলো। পথিমধ্যে সালাত পড়ে প্রাণবন্ত ও শিক্ষণীয় এক সংক্ষিপ্ত ভ্রমণ শেষে ফিরে এলাম আমাদের গন্তব্যে। উপলব্ধি শুধু জ্ঞানীদের জন্য।হ

 


আরো সংবাদ



premium cement