২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

প্রশান্তির খোঁজে

-

ইদানীং জয়ের মন ভীষণ খারাপ। যেন বিরহ-বিষাদে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। ভালো না লাগার মেঘ যেন মনের দক্ষিণ কোণে ঘন কালো অন্ধকারে ছেয়ে আছে। তখন দিগি¦দিকের পরিবেশ-প্রতিবেশ যেন তার কাছে ভয়ানক বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে প্রতি ন্যানোসেকেন্ডে। মুড সুইং তার এর আগেও হয়েছে কিন্তু তার ফ্রিকোয়েন্সি এবার যেন মাত্রাতিরিক্ত। এমন মন খারাপের দিনে জীবন যখন বিরহ-বিষাদে নীল হয়ে উঠে তখন তার একমাত্র সঙ্গী বই।
মনের স্বাভাবিকতা কে প্রাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে বরাবরই বইকে বেছে নেয় জয়। রুমের জানালা খুলে নিজেকে হাল্কা সাজিয়ে নিয়ে মার্শাল ম্যাকলুহানের সমসাময়িক বিশ্বের সাড়া জাগানো লেখক ইউভাল নোয়া হারারির নিয়ে বসল। একসঙ্গে একাধিক বই পড়ার অভ্যাস তার বহু পুরনো। ম্যাকলুহানের বইটি গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়তে ছিল। এর আগে এত গভীর মনোনিবেশ করে বই পড়া হয়নি। আজকে মন কে বিষাদের বেড়াজাল থেকে মুক্ত করতেই যেন এত আত্মমগ্ন হওয়ার সীমাহীন প্রচেষ্টা। মন-মনন সহজাত প্রকৃতি প্রেমে আচ্ছন্ন হওয়ায় বরাবরই প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে সম্পর্কের ইতিবৃত্ত নিয়ে গবেষণা করা হয়। তন্মধ্যে প্রকৃতির প্রতি রুষ্টতার কারণ, প্রকৃতির প্রতি নগ্ন হস্তক্ষেপের হেতু ও সর্বোপরি প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের দুরত্ব বেড়ে যাওয়ার অন্তর্নিহিত কারণটা খুঁজে পেতে চেষ্টা করা হয়। ম্যাকলুহানের গ্লোবালাইজেশন যেন তার এই চিন্তায় নতুন করে ফুয়েল জোগাল।
৬০-এর দশকে বিশ্বগ্রাম বা গ্লোবাল ভিলেজের ধারণাটি আসল। তার পর থেকেই যেন মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির সম্পর্কটা দ্বান্দ্বিকতায় ভরে উঠল, মানুষের সঙ্গে গ্রামীণ জনজীবনের তথা গ্রামের দূরত্ব টা ক্রমশ বেড়ে চলল। আশি-নব্বইয়ের দশকে এ দেশের মানুষের সঙ্গে গ্রামের একটা সহজাত সম্পর্ক ছিল। তখন মানুষ গ্লোবালাইজেশনের রাস্তায় পা বাড়ালেও তখন অবধি গ্রামের সঙ্গে শহরাঞ্চলের একটা মাতৃত্বসুলভ সম্পর্ক ছিল।
গ্রামীণ জনজীবনের হাল-চাল সে নিজেই প্রত্যক্ষ করেছে। তখন তার বয়স কত আর হবে- ৯ কি ১০। বৈশ্বিক প্রযুক্তির উৎকর্ষতার ছোঁয়ায় শহরায়ন-নগরায়নের বাতাস গ্রামের দিকে বইতে শুরু করলেও এতটা কৃত্রিমতা তখন পর্যন্ত ছুঁতে পারেনি। তখন সে যে শহরে বসবাস করত সেখানেও এতটা কৃত্রিমতা ছিল না, ছিল না আজকের এত সুউচ্চ অট্টালিকা, পাকা রাস্তা, ঘন-গিঞ্জি বস্তি। তখন তার শহর টাতে ছিল নির্মল বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ, নগণ্য কিছু সংখ্যক উঁচু উঁচু দালানের বুক চিড়ে বেরিয়ে আসতো সবুজের সমারোহ, কিঞ্চিৎ গাড়ির হর্নের উপর উপরিপাতিত হয়ে ভেসে আসত পাখির কলকলানি, জীবিকার তাগিদে ছুটে চলা ব্যস্ত মানুষের আধিক্যের মাঝেও ছিল একটা দেশীয় অকৃত্রিমতার স্পর্শ।
সারা দিনের কর্মব্যস্ততা শেষে ক্লান্তি কে বিদায় দিতে বিকালের ডুবন্ত সূর্যের পথ ধরে নির্মল বাতাসে দীর্ঘ শ্বাস নেয়া যেত বুক ভরে। চারিদিকের পরিবেশ- প্রতিবেটা ছিল সবুজে সবুজায়িত, কৃত্রিমতাকে পাশ কাটিয়ে জীবনে শান্তির পরশ বুলিয়ে দিতে ঠাঁয় দাঁড়িয়ে ছিল ঘন সবুজ শান্তির নীড়। হালকা বাতাসে যেখানে সবুজের ঢেউ বয়ে যেত যা দোলায়িত তরঙ্গে হৃদয়ে প্রশান্তির এক পশলা বৃষ্টির কারণ হতে দাঁড়াত। এসব সহগ্র অকৃত্রিম বস্তুর মাঝে নির্জীব প্রাণহীন সুবিশাল অট্টালিকা, নি®প্রাণ ইমারত। জন্মলগ্ন থেকেই জয়ের প্রকৃতি নিয়ে ভীষণ কৌতূহল, কিউরিওসিটি। প্রকৃতির রূপ-রস গন্ধের মোহে মাঝেমধ্যেই দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কেবলই ভাবে- গ্লোবাল ভিলেজে কেবল গ্লোবালাইজেশনটাই হয়েছে, আর ভিলেজগুলো কেবল আঁস্তাকুড়ে মরছে। চারিদিকের ব্যতি-ব্যস্ততায় জীবন যখন দুর্বিষহ লাগে, মনে হয় এই ইট-পাথরের রাজ্যে গাড়ির হর্ন আর সোডিয়াম আলোর কৃত্রিমতা জীবন কে আবদ্ধ করে রেখেছে ঘোর অন্ধকারে। তখন কৃত্রিমতায় আড়ষ্ট জনজীবন থেকে মুক্তি পেতে জয় ছুটে চলে নাড়ির টানে গ্রামের দিকে। দীর্ঘ ১২/১৩ ঘণ্টার জার্নি শেষে প্রশান্তির খোঁজে গ্রামে পৌঁছাতে ঢের বেগ পেতে হয়। তারপরও গ্রামের প্রতি তার চৌম্বক সদৃশ আকর্ষণ কাজ করে। ইট-পাথরের নি®প্রভতাকে পাশ কাটিয়ে, হাজারো ব্যস্ততাকে উপেক্ষা করে গ্রামে পৌঁছাতেই বিশালাকার এক বট গাছের দেখা মেলে। দৈত্যাকৃতি বট গাছ সঠান দাঁড়িয়ে জানান দিচ্ছে শান্তির বার্তা। ঠায় দাঁড়িয়ে যেন এই বার্তাই দিচ্ছে- ‘শান্তির রাজ্যে তোমাকে স্বাগতম’। প্রযুক্তির ইউফোরিয়িক উৎকর্ষতায় ভরপুর বিশ্বে আধুনিকতা শহর থেকে গ্রামের দিকে ছুটে চললেও জয়ের গ্রামটা যেন ঠিক গ্রামের সনাতনী সংজ্ঞায় সংজ্ঞায়িত করার এত। ইট-পাথরের আশীর্বাদ পুষ্ট না হয়ে গাছগাছালির সবুজের সমারোহের মাঝে ছোট ছোট ছনের ঘর, আধা-পাকা রাস্তা, বিদ্যুতের ছোঁয়ায় এখনো আলোকিত হয়ে ওঠেনি, সন্ধ্যার নামার প্রারম্ভে আধো-অন্ধকারে পাখিরা নীড়ে ফেরার কলকলানিতে মুখরিত হয়ে উঠে দিগি¦দিক। রাত হলে সোডিয়াম আলোর পরিবর্তে কেরোসিন কুপির মিটিমিটি আলো ভেসে উঠে কল্পিত প্রেতের আগুনমুখো চোখের মতন।
বর্ষায় পথ-ঘাট সিক্ত করে পিচ্ছিল করে দেয়, সেই কর্দমাক্ত পথেও যেন একটা নিজস্বতা আছে, কৃত্রিমতার বিন্দুমাত্র লেশ মাত্র নেই এই নিজস্বতায়। সামান্য বৃষ্টিতে চারদিকের জমি-জিয়ারত সাদা কাচের এত স্বচ্ছ পানিতে টইটম্বুর হয়ে ওঠে। প্রবল বর্ষণে ছনের ঘরের চাল বেয়ে পানি ঘর ভিজিয়ে জানান দেয়- ‘এসো, বন্ধু যুদ্ধ করে বেঁচে থাকি, জল-জীবন-জলাভূমির সঙ্গে সহজাত যুদ্ধ’, ‘যুদ্ধ ছাড়া জীবন যেন সে জীবন্ত নয়, নির্জীব-নি®প্রাণ’। অসময়ের অসাময়িকতায় আড়ষ্ট হয়ে জীবন যেন বিষিয়ে উঠেছে জয়-এর। সময়টা বড্ড খারাপ যাচ্ছে সব মিলিয়ে। যে বন্ধুদের সঙ্গে হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তাদের সঙ্গে অগত্যা অন্তহীন দূরত্ব বেড়েই চলেছে। প্রথম বর্ষের আবেগ-উচ্ছ্বাস উবে যাচ্ছে ক্রমশ। যে বন্ধুদের নিয়ে কার্জন থেকে কলাভবন, আজিমপুর থেকে উত্তরা, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে জিয়া উদ্যান ছুটে চলা হতো হরদম সেখানে ছেদ টেনে দিয়েছে কর্মব্যস্ততা। এখন যে যার এত ব্যস্ত, আগের এত আড্ডা দেয়া না হলেও পথ চলায় দেখা হলে হায়-হ্যালো তেই শেষ। ভবিষ্যৎ নিয়ে বরাবরই একটা উদ্বেগ কাজ করত জয়-এর মনে। পরিকল্পনা খুব সুসজ্জিত, সাজানো না থাকলেও ফার্ম-ডিটারমাইন্ড ছিল- অনার্সের পাঠ চুকিয়েই বিদেশে পাড়ি জমাবে উচ্চ শিক্ষার জন্য। কিন্তু দীর্ঘ দিনের লালিত স্বপ্নে যেন বাজ পরে ছেদ টানল শেষ সেমিস্টারের ফল। জীবনে এই প্রথম সে অকৃতকার্য হওয়ার বিষাদ সদৃশ স্বাদ অনুভব করল। বন্ধুরা সবাই বিদেশে পাড়ি জমাবে, ছুটে চলবে স্বপ্ন কে বাস্তবায়নের পথে। সেখানে তাকে আবার বসতে হবে কৃতকার্য হওয়ার দৌড়ে। জীবন যেন পূর্বের চেয়ে কয়েকগুণ বিষিয়ে উঠল। একরাশ হতাশা ঝেঁকে বসল মাথার উপর, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার সাগরে নিমজ্জিত হয়ে চারদিকে যেন অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে উঠল। জীবনের কোনো সমীকরণ যখন মিলছে না, ঠিক তখনি আবিষ্কার করে ফেলল গ্রামের কথা। জয় এমনিই- যখনি সে জীবনের খেল হারিয়ে ফেলছে তখনি ছুটে চলেছে গ্রামের দিকে। কাউকে কিছু না বলে ব্যাগ গুছিয়ে একটা রিকশা ধরে সোজা বাসস্ট্যান্ডের দিকে। যাওয়ার পথে দু’চোখ ভরে দেখছিল নি®প্রাণ ইমারতগুলো। জীবনের স্বাভাবিক ফ্লো থেকে বিচ্ছিন্ন, বিষাদের নীলকণ্ঠে নীলাভ হয়ে ওঠা মন থেকে ব্যস্ত কোলাহলপূর্ণ শহরের দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিচ্ছিল- ‘তোমার কৃত্রিমতা কেন আমাকে প্রাণভরে শ্বাস নিতে দেয় না? তোমার নির্জীবতা কেন এত রুক্ষ? তোমার নি®প্রাণতা কেন জীবনকে বিষিয়ে তোলে সহসা?


আরো সংবাদ



premium cement