২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

বৈশাখের সেই মেলা

-

আমাদের কৈশোরকালীন বৈশাখী মেলা ছিল খুবই ছিমছাম। এখনকার মতো আয়োজনে অত জাঁকজমক ছিল না। বৈশাখ কী জৈষ্ঠ্য মাস তা ঠিক মনে রাখতাম না। তবে মেলা আসার বার্তা পেতাম গ্রামে পেঁজা তুলো উড়তে দেখলে। মেলার কথা মনে হলেই মনের ইচ্ছাগুলোও ওড়াউড়ি করত তুলোর মতো।
সে সময় আমাদের এখানে খুব বেশি তামাক চাষ হতো। চৈত্র মাস তামাকের ভরা মৌসুম। মা-বাবার অজান্তে সরিয়ে রাখতাম কিছু তামাক। সেই তামাক বিক্রি করতাম। জুটত দশ-বিশ টাকা। আবার সারা বছর চাটাই দেয়া ঘরের বাঁশের খুঁটিতে ছিদ্র করে ব্যাংক বানাতাম। জমাতাম পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা, চারআনা, আটআনা।
মেলার আগের রাতে কেটে ফেলতাম সেই ব্যাংক। গুনে গুনে দেখতাম দশ-বিশ টাকা হতো। সিলভার আর স্টিলের পয়সায় লেগে থাকা বাঁশের ঘুণ ফুঁ দিয়ে পরিষ্কার করলেই চিকচিক করে উঠত। আমরা তৃপ্তির হাসি হাসতাম কয়লায় মাজা ধবধবে দাঁতে।
মেলার আগের রাতে স্বপ্ন বুনতাম। কী কী খেলনা কিনব। কোন কোন মজার খাবার খাবো। কোন কোন সার্কাস দেখব। আপাকে কী কী প্রসাধনী উপহার দেবো।
বাবার সাথে না হয় চাচা বা বড়ভাইদের সাথে মেলায় যেতাম। তবে আপাদের জন্য ছিল বাধ্যবাধকতা। খানিক বেড়ে উঠলে আর তারা মেলায় যেতে পারত না। তবে তাদের বায়না থাকত কাচের চুড়ি, লাল ফিতা, লিপস্টিক, কাজল, তিব্বত পাউডার, আয়না আর চিরুনির। মেলা ঘুরে ঘুরে এসব কিনতাম। কিনতাম তামাক বিক্রি আর বাঁশের খুঁটিতে জমানো টাকায় কাঠের গাড়ি, ব্যাঙগাড়ি, বাঁশি প্রভৃতি। সূর্যের খরতাপে ঘেমে যেতাম। তবুও আনন্দ কাজ করত। বাঁশি বাজত। ব্যাঙগাড়ির ঢঙ-ঢঙ শব্দ কানে লাগত। কাঠের ট্রাক ও পাখিগাড়ি, ঘূর্ণি, লাল-নীল-হলুদ বেলুন কাছে ডাকত। বারুদ দিয়ে ঠাস ঠাস শব্দ করত এক ধরনের টিনের পিস্তল। তা ছিল কিশোর ছেলেদের বিশেষ আকর্ষণের খেলনা।
বেশির ভাগ লোকজনই পায়ে হেঁটে আসত। দূরের লোকেরা ট্রাক ভাড়া করে আসত। উঠতি বয়সী ছেলেদের হুল্লোড় হতো ট্রাকে। গ্রামের মা-চাচীরা সারা বছর টাকা জমাতেন মেলায় ট্রাংক বা বড় বাক্স, বঁটি, দা, কাটার প্রভৃতি। বাবাদের হাতে টাকা দিয়ে বলতেন, ‘পাকা লোহা দেখে কিনবেন।’ আরো কিনতেন কড়াই, পাচুন, খন্তা, ঘুটনি, আলনা, টেবিল, চেয়ার, খাট প্রভৃতি। আর অবশ্যই কাস্তে কিনতেন বাবারা। কারণ ক’দিন পরই ইরি ধান কাটার ধুম পড়ত।
একদিনের জন্য অস্থায়ী দোকান বসাত কাছে দূরের ব্যবসায়ীগণ। তখন সাউন্ডবক্স ছিল না। বড় বড় মাইক বাজত। সেসবে উচ্চস্বরে শোনা যেত বাহারি সব কথা। কত ধরনের গান আর সামনে বসে তাদের খাবার উপভোগের নেমন্তন্ন, জিনিসপত্র কেনার আমন্ত্রণ। পান্তা-ইলিশের আয়োজন সে সময় দেখিনি।
তালপাতার হাতপাখার এক বিশেষ চাহিদা ছিল। একজোড়া বা দুইজোড়া পাখা কিনতেই হতো। কেননা তখন তো গ্রামে বিদ্যুতের ব্যবস্থা ছিল না। ওই তালপাতার পাখা দিয়েই বাতাস করতে হতো। সারি সারি বসত চিঁড়া-মুড়ি, দোভাঁজা প্রভৃতির দোকান। মেলা থেকে ফেরার পথে প্রায় সবাই ইলিশ মাছ কিনতেন। ইলিশের সাথে জিলাপি, মুড়ি, জলপান নিতে হতো বাড়ির জন্য। আর গোয়ালারা গ্লাসের মতো মাটির খুঁটিতে দই বেচতেন। সেই দই আর জলপান ছিল গ্রামীণ মায়েদের বিশেষ পছন্দের খাবার।
গরম টসটসে জিলাপিতে কামড় দিতাম শিরা ঝরে পড়ত। মুখ ভরে যেত মিঠায়। কাঠের বাক্সে করে আইসক্রিম বিক্রি করত। ঢুকঢাক শব্দ করে জানান দিত তাদের অবস্থান। নারকেল আইসক্রিমের চাহিদা ছিল বেশি। বৈশাখের খরোতাপের তেষ্টায় গোটা পাঁচেক খেতাম।
বিশাল প্যান্ডেলের ভেতর সঙ সাজানো বাঘ-ভাল্লুকের খেলা দেখতাম। দি রওশন সার্কাস ছিল নামকরা। দেশের গান দিয়েই সার্কাসের শুরু হতো। এক চাকার সাইকেল চালানো দেখে বিস্মিত হতাম! চোখ বেঁধে ছুরি ছুড়ে দিত এক খেলোয়াড়। কী নিশানা! নিশানার স্থানে থাকা লোকটিকে একটুও স্পর্শ করত না ছুরি। সেই উঁচুতে ওঠে লম্ফঝম্পও করতেন খেলোয়াড়রা। সাপের খেলা দেখাতেন সাপুড়েরা। এ খেলার মূল উদ্দেশ্য ছিল তাবিজ বিক্রি। বানরের নাচ দেখতাম। বন মানুষ দেখলেই হাসিতে লুটিয়ে পড়তাম। বায়োস্কোপ দেখার সময় সুরে সুরে ছবির বর্ণনা শুনতাম। আমরা সেসব দৃশ্য দেখছি আর যেন সেই দেশেই হেঁটে চলেছি।হ


আরো সংবাদ



premium cement