২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

জীবনের স্বাদ ও বিষাদ

-

যদি এভাবে বলা যায়; বস্তুর স্বাদ বুঝি, বিষাদও বুঝি, কিন্তু বস্তুটাকেই যদি না বুঝি, তাহলে কেমন শোনায়? নিশ্চয় হয়তো ভালো শোনায় না। তার পরও কিছু কিছু জিনিস চিন্তা করে বুঝে নিতে হয়। বলা হয়ে থাকে ‘বৃক্ষ তোর নাম কি ফলে পরিচয়’। অর্থাৎ ফল দেখে বৃক্ষ চেনা। এভাবে জীবনও চেনা যায় স্বাদের জোয়ারে এবং বিষাদের ভাটাতে। জীবনকে যদি ফল বা বস্তুর সাথে তুলনা করা হয় তবে বলা যাবে, এটি এমন একটি ফল বা বস্তু যার মধ্যে একই সাথে স্বাদও আছে বিষাদও আছে। শুধু স্বাদ আছে কিংবা শুধু বিষাদ আছে জীবন এমন বস্তু নয়। এজন্যই বোধ হয় লোকে বলে, জীবনের জোয়ারভাটায় সুখ জিনিসটাকে খুঁজে নিতে হয়। তাহলে জোয়ার-ভাটা কিংবা স্বাদবিষাদই কি জীবন? তা হয়তো নয়। জোয়ারভাটা বা স্বাদ বিষাদের ঘোলাজলে সাঁতার কেটে যে অভিজ্ঞতার সঞ্চার হয় তার সামগ্রিক উপলব্ধিই জীবন; এটি হয়তো সাহিত্যের ভাষা। তবে জীবনের সনির্বন্ধ সংজ্ঞাও এটি নয়।
জীবন জিনিসটা কি তা বোঝার জন্য রয়েছে জীববিদ্যা বা প্রাণিবিদ্যা। জীববিজ্ঞানের ভাষায় প্রোটোপ্লাজমের ক্রিয়াকলাপকে বলা হয় জীবন। জীববিদ্যা মতে, প্রতিটি কোষই এক একটি জীবন। যেমন অণুজীব, ব্যাক্টেরিয়া, ভাইরাস। ধর্মে জীবনকে আত্মা বা রূহ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। এই রূহ বা আত্মা জিনিসটা কেমন তার পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যায় না। কুরআনুল কারিমে বলা হয়েছে ‘বলো, রূহ আমার রবের আদেশ থেকে, আর তোমাদেরকে জ্ঞান থেকে অতি সামান্যই দেয়া হয়েছে।’ (সূরা বনি ইসরাইল,৮৫) কুরআনের এ বক্তব্য অনুযায়ী আত্মা বিষয়ে মানুষের জ্ঞান সীমিত। জীবনের অস্তিত্ব ও বিকাশ অনুধাবন করে বিজ্ঞানী এবং দার্শনিকরাও জীবনকে সংজ্ঞায়িত করা দুরূহ ব্যাপার বলেই মনে করেছে। বিজ্ঞানতত্ত্বে জীবন হলো একটি প্রক্রিয়া, কোনো বস্তু নয়। বস্তু নয় বলেই জীবনের ব্যাপ্তি, সীমা-পরিসীমা, আকার-আয়তন, ভর, বিন্যাস না থাকলেও জীবন যে রহস্যময় তা দ্ব্যর্থহীনভাবেই অনুভব করা যায়।
বিজ্ঞানে জীবনকে দেখা যায় মাইক্রোসকোপের নিচে আর সাহিত্যে জীবনকে দেখা যায় কলমের খোঁচায়। বিজ্ঞান কোষকে কাটাছেঁড়া করে আর সাহিত্য জীবনের অনুভূতিগুলোর ডালপালা মেলে ধরে। সেজন্য জীবন ও সাহিত্য নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। সম্পর্কযুক্ত এ জন্যও যে, জীবনকে প্রত্যন্তভাবে অবলোকন করার সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য প্লাটফর্ম হচ্ছে সাহিত্য। অর্থাৎ জীবনকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে সাহিত্য। আবার সাহিত্যের ওপর ভর করে জীবন হয় পরিস্ফুট। কাজেই জীবন ছাড়া সাহিত্যের পাতা যেমন একবারেই নীল থাকে তেমনি সাহিত্য ছাড়া জীবনের প্রকাশও অন্ধকারে থাকতে পারে। এ ক্ষেত্রে জীবন আগে, সাহিত্য পরে। জীবন থাকবে না তো সাহিত্যও থাকবে না।
সাহিত্যের বিবেচনায় স্বাদবিষাদের রঙ-বেরঙের পাখিগুলো জীবনকেন্দ্রিক আবর্তিত হতে থাকে। এই আবর্তে স্বাদের পাল্লা ভারী হলে জীবন সুন্দর হয় আর বিষাদের পাল্লা ভারী হলে জীবন করুণ নিদারুণ দুঃখময় হয়ে ওঠে।
স্বাদ সুখের অনুভূতি সৃষ্টি করে আর বিষাদ কষ্টের। জীবনের প্রত্যাশা থাকে বিষাদকে পাশ কাটিয়ে চলা। কিন্তু জীবনের গতিতে স্বাদের চাকাটি হয়তো ব্যাসার্ধে একটু বড়। এজন্যই বুঝি জীবন বিষাদের ছোট চাকাটির ওপর বার বার ঝুঁকে যায়।
অনেকে বলে থাকে, বিষাদে না পড়লে জীবনকে বোঝা যায় না। কথাটা একবারে নেহাতই অসত্য নয়। স্বাদের চেয়ে বিষাদই জীবনকে উন্মোচিত করে সবচেয়ে বেশি। কেবলমাত্র স্বাদে টইটম্বুর যে জীবন, সে জীবন অনেকখানি মন্থর; অনেকখানি প্রতিবন্ধী। বিষাদের মধ্যেই স্বাদ থাকে। যেমন মাতৃত্বের স্বাদ। সন্তান প্রসবের সময় মা যে তীব্র যন্ত্রণা বা বিষাদ অনুভব করে এই বিষাদই পরে স্বাদে রূপান্তরিত হয়। মা হয়ে ওঠে মাতৃত্বের স্বাদে পরিপূর্ণ। জীবনের স্বাদ এরকমও হতে পারে। অনেক সময় স্বাদও বিষাদে পরিণত হতে পারে। যেমন হয়েছিল রাজা ইডিপাস নাটকে ইডিপাসের জীবনে। ইডিপাস বাদশাহী জীবনের স্বাদ উপভোগ করে আসছিল। হঠাৎই তার জীবনে নেমে এলো বিষাদের কালো মেঘ। ইডিপাস আত্মক্লেশে জীর্ণ হলো। জীবন যে সমান্তরালে চলে না ইডিপাসের বুঝতে বাকি থাকল না। ইডিপাসকে কেউ হত্যা করেনি। জীবনের বিষাদের কাছে ইডিপাস নিজেই নিজেকে পরাজিত করে। জীবনের স্বাদ ও বিষাদ দুটোকেই ইডিপাস পেয়েছিল কিন্তু তীব্র বিষাদে ইডিপাস টিকে থাকতে পারেনি।
জীবনের আরম্ভ আছে, পরিসমাপ্তিও আছে। তবে জীবনের পরিসীমা কতটা লম্বা হবে সেটা যেমন নিশ্চিত নয়; তেমনি জীবনের ব্যাপ্তিতে কতটা স্বাদ আর কতটা বিষাদ থাকবে তা-ও নিশ্চিত নয়। যে স্বাদ নিয়ে জীবনের আরম্ভ হয়, সেই স্বাদ পরিণতিতে গিয়ে বিষাদে রূপান্তরিত হয়। তবুও পরিণতিতে পৌঁছে জীবন তার প্রারম্ভের স্মৃতি বা স্বাদকে রোমন্থন করতে থাকে। এই রোমন্থনের ভেতর দিয়েই জীবনের পরিপূর্ণ স্বাদ উপভোগ করা সম্ভব হয়। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement