২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

ব্রিটিশ বাংলার সেই জাগরণ

-


১৮৮৯ সালে কলকাতা মোহনবাগান ক্লাব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে ফুটবলজগতে কলকাতাবাসীর উচ্ছ্বাসের শুরু। তারপর কত গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, আগস্ট, সেপ্টেম্বর, অক্টোবর মাস বছর কেটে গেল কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। এরপর দীর্ঘ ২২ বছরের মাথায় অর্থাৎ ১৯১১ সালে হঠাৎ একদিন চরম উত্তেজনা নিয়ে দর্শকরা সকাল থেকেই গ্যালারি ভরে ফেলল। কারণ ছিল কলকাতা মোহনবাগানের সাথে ইস্ট ইয়র্কশায়ার রেজিমেন্টের ফুটবল ফাইনাল। চরম উত্তেজনাকর ফাইনালে মোহনবাগান জিতে গেল। প্রথমবারের মতো সর্বভারতীয় দল হিসেবে কলকাতা মোহনবাগান স্পোর্টিং ক্লাব ইংরেজ কোনো দলকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। এরপরের ইতিহাস বড় বেশি ম্যাড়মেড়ে। একের পর এক হার, বছরের পর বছর কলকাতার মানুষ হুড়মুড় করে মহা উত্তেজনা নিয়ে ফুটবল খেলা দেখতে যায়। আজ বোধহয় কিছু একটা হবে, একটা কিছু ঘটে যেতে কতক্ষণ। ঘটনা ঘটে তবে যা ঘটে তা একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি অর্থাৎ বারবার শুধুই হার। সব সময়ই তা দেখে আসছে তারা, শুনে আসছে ট্রামে বাসে, ঘরের মাঠের আড্ডায়, ম্যাসের ভেতর। আজ ইস্টবেঙ্গল ডারহামসের কাছে হেরেছে, কয়টা খেয়েছে জানিস? জেনে আর কী হবে? গতকাল মোহনবাগান হেরেছিল ক্যালকাটা ডালহৌসির সাথে। এসব নিত্যকার হারার খবর কলকাতার ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রিত পত্রিকাগুলোয় বেশ অহমিকার সাথে ছাপে। তাদের দল ডালহৌসী, তাদের দল ডারহামস, কে আর আর, পুলিশ ও কাস্টমস। তাদের সাথে কোনোভাবেই জিততে পারছে না ব্রিটিশ বাংলার ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগান ক্লাব এরিয়ান স্পোর্টিং ইউনিয়ন, হাওড়া ইউনিয়ন। অথচ গ্যালারি ভর্তি দর্শক শুধু বল দেখে, বল পায়ে দেখে আর উত্তেজিত হয় খেলা শেষে বাড়ি ফেরে, ‘ইস, একটুর জন্য আরেকটু হলে গোলটা প্রায় হয়েই গেছিল,’ এই আফসোস নিয়ে। খেলার মাঠে বল দাপিয়ে বেড়ায় অসম প্রতিযোগিতায়। কারণ সবাই খেলা শেষের রেজাল্ট সম্বন্ধে মোটামুটি নিশ্চিত থাকে, দেশীয় টিম হারবে আর ইংরেজদের দল জিতবে। এটিই হয়, হয়েছে, হচ্ছে। সেই কত বছর আগে ১৯১১ সালে ইস্ট ইয়র্কশায়ার দলকে পরাজিত করে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল কলকাতা মোহনবাগান ক্লাব। সে বছরই আবার বঙ্গভঙ্গ রদ ঘোষণা করা হলে পূর্ববঙ্গের মুসলমানেরা ফুটবলের খবরে আশান্বিত হলেও নিজেদের অস্তিত্বের বিকাশে হতাশ হয়েছিল। তারপর আর কোনো ভালো খবর তৈরি হচ্ছে না ক্রীড়া জগতে। উত্তেজনার পারদ কমছে। কিন্তু বেকারের দল বাড়ছে। দর্শক গ্যালারিতে দর্শক বেড়েই চলছে। হঠাৎ করেই কী একটা ঘটনা শুরু হয়ে গেল ১৮৯১ সালে, আব্দুল গফুর মাওলানা ও হাবিবুল্লাহ বাহারের প্রতিষ্ঠিত কলকাতা মোহামেডান ক্লাব ১৯৩৩ সালে দ্বিতীয় বিভাগ চ্যাম্পিয়ন হয়ে প্রথম বিভাগে খেলার গৌরব অর্জন করে। এ গৌরবে মুসলমান দর্শকদের মধ্যে ক্রীড়া ক্ষেত্রে নতুন আলোড়ন সৃষ্টি করে। ১৯৩৪ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব প্রথম বিভাগে প্রথমবারের মতো খেলতে নেমেই একের পর এক বড় বড় নামীদামি দলকে হারিয়ে দিয়ে কলকাতার দর্শকদের মন জয় করে চলছে। কলকাতার খেলার মাঠে ক্রীড়ামোদি মুসলমানদের সংখ্যা এমনিতেই কম ছিল না। প্রথম বছরেই মোহামেডানের একের পর এক জয় তুলে নেয়ার ফলে প্রথম বিভাগের খেলা দেখতে আসা দর্শকদের সংখ্যা বহুগুণ বেড়ে যায়। প্রাকৃতজনরা বলল, মাঝে মধ্যে এমনটা ঘটে দৈবে। এটিকে বলে অঘটন। এই অঘটন মাঝে মধ্যেই ঘটতেই পারে। কিন্তু অঘটনটা আর মাঝে মধ্যে থাকল না, ম্যাচের পর ম্যাচ জিতে মোহামেডান তখন ফাইনালে উঠে গেছে। কলকাতার অফিস আদালতে, পার্কে ফুটপাথে, ঘরের মাঠে, বাস ট্রামে কি মেস বাড়ি, কি বৈঠককানায়, সবখানেই মোহামেডানের ফাইনাল খেলার খবর উড়ে বেড়াচ্ছে। অফিসের ছুটি নিয়ে দ্রুত চলে যেতে হবে খেলার মাঠে, দেরিতে গেলে মাঠে ঢোকা যাবে না। এমনসব উত্তেজনা বিরাজ করছে তরুণ যুবাদের মধ্যেও। গ্যালারি ভরে গেছে অনেক আগেই। দাঁড়িয়ে থাকার অবস্থাও নেই। খেলা চলছে দু’দলই লড়ছে সমানে সমান। আজ একটা এসপার ওসপার না করে ছাড়ব না। মোহামেডানের খেলোয়াড়দের পায়ে বল মানেই দর্শকদের হইহুল্লোড়ে পুরো স্টেডিয়াম ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। গোল হয়ে গেল গোল। মোহামেডান গোল দিয়েছে। মোহামেডান জিতে গেছে। হই হই রই রই কাণ্ড। কলকাতা মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন। মোহামেডান ফুটবল দল জেতেনি জিতেছে ভারত, মারোয়াড়ি, বাঙালি, হিন্দু মুসলিম মুচি মেথর সকলের কাছেই আজ ব্রিটিশকে হারিয়ে দেয়ার খবর বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে। আবার ভয়ও হচ্ছে এ জয়ের পর আবার কত বছর অপেক্ষা করতে হবে। যেমনটা হয়েছিল মোহনবাগানের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার দীর্ঘ ২৩ বছর পর। কিন্তু এবার আর তা ঘটল না অপেক্ষার পারদ উঁচুমুখী পরের বছর আবার মোহামেডান চ্যাম্পিয়ন। এর পরের বছরও চ্যাম্পিয়ন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। ব্রিটিশ দলগুলো হতবাক। প্রথম বিভাগে উঠে প্রথম বছর থেকেই মোহামেডান স্পোর্টিং যে একটানা বিজয় অভিযান শুরু করল, তা কলকাতার খেলার মাঠে সৃষ্টি করতে থাকল একের পর এক ইতিহাস। কলকাতাবাসী ও মুসলমানদের জীবনে এ ঘটনা অভূতপূর্ব অনুপ্রেরণা নিয়ে এসেছিল। কলকাতার মাঠের খেলায় এ দেশী দর্শকদের উত্তেজনা জোগাত সাধারণত সাহেবী টিমগুলোর সাথে এ দেশী দলগুলোর প্রতিযোগিতা। এতদিন ইউরোপীয় খেলোয়াড়দের ক্রীড়া বৈশিষ্ট্যই ক্রীড়ামোদীদের আলোচ্য বিষয় ছিল। ব্যক্তিগতভাবে এ দেশের সামাদ, শিব ভাদুড়ী, বিজয় ভাদুড়ীর খেলার তারিফ শোনা যেত। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের কারণে সামাদকে ফুটবল জাদুকর হিসেবে এ দেশী-বিদেশী সব ক্রীড়ামোদীই অঢেল প্রশংসা করেছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সম্মিলিত দলীয় ক্রীড়া নৈপুণ্যে ইউরোপীয়দের সাথে পেরে ওঠা এ দেশের খেলোয়াড়দের একক নৈপুণ্যে সম্ভব ছিল না। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবই প্রথম এই প্রমাণ দিলো যে, শুধু ব্যক্তিগত ক্রীড়া নৈপুণ্য হিসেবে নয়, দলগত ক্রীড়া নৈপুণ্যেও এদেশীও দল ইউরোপীয়দের ওপর টেক্কা দিতে পারে। মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের বিজয় ঘোড়া একটানা ১৯৪১ সাল পর্যন্ত টানা আট বছর (সাত বছর) ক্লান্তিহীন গতিতে চলল। মাঝের এক বছর আইএফএ কর্তৃপক্ষের অবিচারের প্রতিবাদে মোহামেডান স্পোর্টিং লিগ খেলা বর্জন করায় সে বছর মোহনবাগানকে চ্যাম্পিয়ন ঘোষণা করা হয়। ১৯২৭ সালে কলকাতা মোহামেডানের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য ঐতিহাসিক খাজা পরিবারের খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় মুসলিম স্পোর্টিং ক্লাব নামে একটি ক্লাব গঠন করেন। কলকাতা মোহামেডানের সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে ১৯৩৬ সালে মুসলিম স্পোর্টিং ক্লাবটির নাম পরিবর্তন করে নাম দেন মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব। সেই থেকে পূর্ববঙ্গে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের যাত্রা শুরু হয় ঢাকা মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব নামে। শুধু লিগ চ্যাম্পিয়নই নয় ১৯৩৬ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব আই এফ এ শিল্ডও জয় করে নেয়। ১৯৪১ সালে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব একাধারে লিগ শিরোপা, আই এফ এ কাপ, বোম্বাইর রোভার্স কাপ, সিমলার ডুরাল্ড শিল্ড এবং দিল্লির আব্দুল গফুর কাপ জয় করে নেয়। মূলত কলকাতার প্রথম বিভাগ ফুটবলে মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের অভ্যুদয় ভারতীয় ফুটবলে ইউরোপীয় প্রাধান্যকে সমূলে উপড়ে ফেলে। যা ছিল তৎকালীন সময়ে কল্পনাতীত। এমন কল্পনাতীত ব্যাপার মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব কর্তৃক বাস্তবায়িত হওয়ায় শুধু কলকাতা নয়, সারা ভারতের ক্রীড়া জগতেই মোহামেডান নামের জয়ধ্বনি শুরু হয়। শুধু কলকাতার মুসলমানরাই নয়, সারা বাংলার মুসলমানরাই মোহামেডান দলের এই বিজয়কে তাদের নব অভ্যুত্থানের সূচনা বলে গ্রহণ করে। মোহামেডান দলের সামাদ, রশীদ, রহমত, রহীম, আব্বাস, নাসিম, সাবু, মাসুম, জুম্মা খা, বাচ্চি খা, নুর মোহম্মদ (বড়), নুর মোহম্মদ (ছোট), সলীম প্রমুখ ফুটবল বীরদের নাম কলকাতার ক্রীড়া দর্শকদের মুখে মুখে ফিরতে থাকে। শহর ছাড়িয়ে সুদূর পল্লীর ক্রীড়া ক্ষেত্রেও ক্রীড়ামোদীদের মুখে মুখে তাদের নাম উচ্চারিত হতে থাকে। বস্তুত, মোহামেডান স্পোর্টিংয়ের বিস্ময়কর বিজয় বাংলার মুসলমানদের মধ্যে যে উত্তেজনা ও উৎসাহের সৃষ্টি করেছিল, এমন আর ইতঃপূর্বে ঘটেনি। ফলে বাংলার মুসলমান জাতীয় জাগরণের মূলে মোহামেডান স্পোর্টিংয়ের বিজয়বার্তা যে অনেক বেশি সক্রিয় হয়েছিল, তাতে সন্দেহের অবকাশ নেই। এর পরপরই একটা কথা প্রবাদবাক্যেও পরিণত হয়ে উঠেছিল, ‘নজরুল ইসলামের কবিতা, আব্বাসউদ্দিনের কণ্ঠে নজরুলের জাতীয় সঙ্গীত এবং মোহামেডান স্পোর্টিংয়ের বিজয় অভিযান বাংলার মুসলিম জাতীয় জাগরণের মূলে অপ্রতিরোধ্য প্রভাব বিস্তার করেছিল।’
মোহামেডান দলের এই অভূতপূর্ব বিজয় অভিযানের চমকপ্রদ বিবরণ তখন বাংলার হাটে-মাঠে ছড়িয়ে দিয়েছিল ‘সাপ্তাহিক মোহম্মদী’ ও ‘মাসিক মোহম্মদী’। কবি গোলাম মোস্তফা সে সময় এ বিজয় অভিযান সম্পর্কে একটি সুন্দর কবিতা- ‘লিগ বিজয় না, দিগ বিজয়!’ লিখেছিলেন। কবি নজরুল ইসলামও মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের বিজয় উপলক্ষে ‘মোবারকবাদ’ শীর্ষক একটি চমৎকার কবিতা লিখেন। ‘সাপ্তাহিক মোহম্মদীতে’ এগুলো ছাপার পাশাপাশি পুস্তক আকারে ছেপেও খেলার মাঠে হাজার হাজার কপি বিতরণ করা হয়। এর ফলে কলকাতার ক্রীড়ামোদীদের মধ্যে বিপুল আলোড়নের সৃষ্টি হয়। হাবিবুল্লাহ বাহার ও মোহম্মদ মোদাব্বের স্বনামে এবং আবুল কালাম শামসুদ্দিন ছদ্মনামে ‘মোহম্মদীতে’ এ বিজয় অভিযানের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। এভাবে ক্রীড়া ক্ষেত্রে বিজয় অভিযানের সাথে সাহিত্য মিলে মিশে একাকার হয়ে মুসলমানদের স্বকীয়তা প্রকাশে সোচ্চার হয়ে উঠেছিল।


আরো সংবাদ



premium cement

সকল