২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

জীবনের ঘানি

-

নতুন বিয়ে হয়েছে। বউয়ের চোখে-মুখে রাজ্যের জড়তা। হাতে মেহেদির রঙ তখনো শুকায়নি। এই অবস্থায় স্বামীর সাথে কাজে নেমে পড়েন তিনি। সরিষার ঘানি ভাঙার কাজ। ৩০ বছর ধরে এই দম্পতি ঘানি টানছেন। ঘানি গরুতে টানলেও তারা নিজেরাই টানছেন। ঘানি টানতে টানতে কাঁধে দাগ পড়ে গেছে। অসুস্থ হয়ে পড়েছেন অসংখ্যবার। দুইবার স্ট্রোক করেছেন। কথা বলতে, চলতে ফিরতে অসুবিধা হয়। কিডনিসহ নানা অঙ্গে সমস্যা দেখা দিয়েছে। তবুও থেমে থাকেনি তাদের ঘানি টানার কাজ। গড়ে প্রতিদিন ৮ থেকে ৯ ঘণ্টা ঘানি টানেন তারা। এরই মাঝে ৩০টি বছর কেটে গেছে। ছেলেমেয়ে বড় হয়েছে। কিন্তু তাদের ভাগ্যে পরিবর্তন আসেনি। বরং ছেলেমেয়েরাও ঘানি টানতে সহায়তা করে। ঘানি টেনে জীবনকে সচল রাখার এই গল্প লোকমান হোসেন (৫৫), মরিয়ম বেগমের (৪৫)। দু’জনার বাড়ি সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার শিয়ালকোল ইউনিয়নের বিলধলী গ্রামে। ঘানি বিলুপ্তিপ্রায়। গ্রামগঞ্জে অল্প কিছু ঘানি থাকতে পারে। তবে সেগুলো মানুষ নয় গরু দিয়ে টানানো হয়। সব কিছুতেই যেখানে আজকাল আধুনিকতা, যান্ত্রিকতার সরব উপস্থিতি। সেখানে টানা ৩০ বছর মানুষের ঘানি টানার ঘটনা বিরল। লোকমান দম্পতি এই বিরল ঘটনার জ্বলন্ত উদাহরণ। এখন সরিষার তেল মেশিনে উৎপাদন হয়। খরচ, সময় দুটোই বাঁচে। তবে বিশুদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। এ কারণে কিছু মানুষ এখনো ঘানিভাঙা সরিষার তেল খোঁজ করেন। তাই খুব সামান্য কিছু মানুষ এখনো ঘানিতে সরিষা উৎপাদন করেন। লাভক্ষতি নয়। বাপ-দাদার পেশা। সে কারণে তারা এটা ধরে রেখেছেন। লোকমানও বলছিলেন সে কথা। ‘বাপ-দাদার পেশা ছাড়তে পারিনি। এ পেশা বাপ-দাদার আমলের। বাবা হালাল উপার্জনের জন্য এই পেশায় থাকতে বলেছেন। বলেছে কোনো দিন হারাম খাবি না, যার জন্য এই পেশায় আছি, বলছিলেন লোকমান হোসেন।’ তিন ছেলে, এক মেয়েকে নিয়ে লোকমানের সংসার। দু’টি ঘানি তার। দু’টি ঘানির জন্য দু’টি গরু প্রয়োজন। একটি ঘানি কিছুদিন আগ পর্যন্ত গরু দিয়ে চালাতেন। গরু বৃদ্ধ হয়ে অচল হয়ে যাওয়ায় সে ঘানিটি তিনি টানেন। অপরটি টানতে পালা করে স্ত্রী-সন্তানরা সহায়তা করেন। চক্রাকারে ঘানি টানতে হয়। ঘানির দুই পাশের বাঁশ ধরে দু’জনকে ঘুরতে হয়। ফলে মাথা ঘুরানো, বমিসহ নানা রকম অসুবিধা দেখা দেয়। ঘাড়ে, কাঁধে ব্যথা হয়। লোকমান দম্পতিও নানা ব্যাধিতে আক্রান্ত। লোকমানের বউ মরিয়ম বেগম বলছিলেন, ‘বিয়ের পর থেকেই স্বামী-শ্বশুরকে ঘানি টানতে দেখেছি। আমিও তাদের সাথে ঘানি টানা শুরু করি। প্রথমে খুব মাথা ঘুরত। তারপরও ঘানি টানা ছাড়া অভাবের সংসারে উপায় ছিল না।’ এভাবে ৩০টি বছর কেটে গেছে মরিয়মের ঘানি টানায়। এখন তার কিডনিতে সমস্যা। ডাক্তার ভারী কাজ করতে নিষেধ করেছেন। তারপরও তাকে বাধ্য হয়ে ঘানি টানতে হচ্ছে। এ যেন ভাগ্যের কাছে নিরুপায় আত্মসমর্পণ। দু’মুঠো খাবারের জন্য তিলে তিলে নিজেকে নিঃশেষ করে দেয়া। লোকমান দম্পতি ঘানি টেনে যা আয় করেন। তাতে টেনেটুনে সংসার চলে। লোকমান নিজেও অসুস্থ। দু’জনার প্রতিদিন বেশ কিছু ওষুধ খেতে হয়। তারপরও বাপ-দাদার পেশা আঁকড়ে ধরে আছেন লোকমান।
লোকমান বলছিলেন, ‘ঘানি না টানলে খাবো কী? ঘানি টানার জন্য গরু কেনার সামর্থ্য নেই।’ লোকমানের কাছেই জানা গেলÑ প্রতিদিন এক মণ সরিষা ঘানির মাধ্যমে তেল হয় ১০ থেকে ১৫ কেজি। প্রতি কেজি বিক্রয় হয় ২২০ থেকে ২৫০ টাকা। এর মাঝে লোকমান দম্পতির ঘানি টানার খবর জানাজানি হয়ে গেছে। খবর পেয়ে সম্প্রতি তাদের সাহায্যে এগিয়ে এসেছে স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ডু সামথিং ফাউন্ডেশন ও অংকুর ইন্টারন্যাশনাল। তাদের যৌথ উদ্যোগে গত ১৫ অক্টোবর ৬৮ হাজার ৫০০ টাকা মূল্যের একটি ষাঁড়গরু কিনে লোকমানের হাতে তুলে দেন। ১৭ অক্টোবর র্যাব-১২ একটি ছয় মাসের গর্ভবতী গরু লোকমানকে উপহার দেয়। যেন গরু পালন করে অর্থনৈতিকভাবে তিনি লাভবান হতে পারেন।
গরু পেয়ে লোকমান দম্পতির মুখে হাসি ফুটেছে। লোকমান বলেন, ‘আমি খুব খুশি। আগে খুব কষ্ট হতো।’ ৩০ বছর যে অমানবিক পরিশ্রম তিনি করেছেন। এবার হয়তো তা থেকে একটু হলেও বিশ্রামের সুযোগ মিলল।


আরো সংবাদ



premium cement
অবন্তিকার আত্মহত্যা : জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের জামিন আবারো নামঞ্জুর পাথরঘাটায় বদর দিবস পালনে দেড় হাজার মানুষের ইফতারি আদমদীঘিতে ৭২ হাজার টাকার জাল নোটসহ যুবক গ্রেফতার সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান মির্জা ফখরুলের জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : মন্ত্রী গাজীপুরে গাঁজার বড় চালানসহ আটক ২ দুই ঘণ্টায় বিক্রি হয়ে গেল ২৫০০ তরমুজ ড. ইউনূসের ইউনেস্কো পুরস্কার নিয়ে যা বললেন তার আইনজীবী একনেকে ৮৪২৫ কোটি টাকার ১১ প্রকল্প অনুমোদন সান্তাহারে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে যুবক নিহত জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : আব্দুর রহমান

সকল