২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

নদীর বুকে পেয়ারা

-

সরূপকাঠীর আটঘর কুড়িয়ানা, ঝালকাঠীর ভীমরুলিতে বসে ভাসমান পেয়ারার হাট। তিন-চারটি খালের মোহনায় পেয়ারাভর্তি নৌকা জড়ো হয়। ভাসমান অবস্থায় পেয়ারা বিক্রি হয়। দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকাররা তা কিনে নিয়ে যান। ভাসমান এই হাটের বয়স দেড় শ’ বছর পেরিয়ে গেছে। পেয়ারা ছাড়া কাগজি লেবু, আমড়া, সুপারি, কলা, বোম্বাই মরিচসহ অন্যান্য সবজিও বিক্রি হয়। বলা হয়ে থাকে, থাইল্যান্ডের ফ্লোটিং মার্কেট, কেরালার ব্যাকওয়াটার মার্কেটের চেয়েও এখানকার ভাসমান হাট সুন্দর। লাখ লাখ পর্যটক আসেন এখানে।
এই এলাকার প্রায় ২০ কিলোমিটার দূর-দূরান্ত থেকে চাষিরা আসেন। সাথে থাকে নৌকাভর্তি তাজা টসটসে পেয়ারা। জানা যায়, আটঘর কুড়িয়ানাসহ বানারীপাড়া, সরূপকাঠী, ঝালকাঠী সদর উপজেলার প্রায় ৩৪টি গ্রামে পেয়ারার চাষ হচ্ছে। ২০ সহস্রাধিক মানুষ পেয়ারা চাষের সাথে জড়িত। খুব সকালে চাষিরা পেয়ারা পাড়েন। হাট সকাল ১০টার মধ্যে শেষ হয়ে যায়। ছোট ছোট নৌকায় করে তারা আসেন। দেখলে মনে হবে সব যেন একজনের হাতে তৈরি। আসলে তা নয়। পেয়ারা ছাড়াও আখ, বোম্বাই মরিচ, আমড়া, কাগজি লেবু, সুপারি চাষও তারা করেন। শুশান্ত দেবনাথ। ৪০ বছর ধরে পেয়ারা চাষ করছেন। বংশ পরপম্পরায় তিনি পেয়ারাচাষি। শুশান্ত জানালেন, এই এলাকায় এমনও বাগান আছে। যার বয়স ২০০ বছর পেরিয়ে গেছে। তিনি বলছিলেন, পর্যটকরা আগের চেয়ে বেশি আসায় তাদের কদর বেড়েছে। এলাকারও উন্নতি হয়েছে। সংরক্ষণাগার নেই। সে কারণে পেয়ারা পচে নষ্ট হয়।

এ যেন মিনি সুন্দরবন
ছোট সরু খাল। জোয়ারে পানি থাকে। ভাটায় শুকিয়ে যায়। খালের চারপাশে গাছগাছালিতে ভরা। গাছের ফাঁক পেরিয়ে কখনো মিষ্টি রোদ পড়ে। কোথাও বা অন্ধকার। আলো-আঁধারির এই পরিবেশ যেন সুন্দরবনকেও হারায় মানায়। সুন্দরবনের মধ্যে যে রকম ছোট ছোট খাল, এখানকার খালগুলো সে রকমই। স্থানীয় ভাষায় একে ভারানী বলা হয়। আটঘর থেকে ভীমরুলি যেতে কয়েকটি ভারানী পেরোতে হয়। পথে গাছভর্তি কাঁচা-পাকা পেয়ারা, বোম্বাই মরিচ, আখ, শসাসহ সব সবজির দেখা মিলবে। নৌকা বা ট্র্রলারে বসে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে এসব। ফেসবুকে আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারাবাগান, ভাসমান হাটের ছবি দেখে ভালো লাগে। এই এখান নৈসর্গিক সৌন্দর্য আসলে সরাসরি না দেখলে কেউ বুঝবে না। খালগুলো সুন্দরবনের মধ্যের খালের চেয়েও সুন্দর।

বাংলার আপেল
আটঘর কুড়িয়ানার পেয়ারাকে বলা হয় বাংলার আপেল। খেতে সুস্বাদু, পুষ্টিগুণে অনন্য। আমলকী বাদে সব চেয়ে বেশি ভিটামিন সি আছে পেয়ারায়। ১০০ গ্রাম পেয়ারায় ১৮০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি আছে। আরো আছে ভিটামিন বি১, বি২, প্রোটিন, কার্বোহাইডেট, আয়রণ ও ফসফরাস। জানা যায়, দেশী পেয়ারার প্রায় ষাট শতাংশ এখানে উৎপাদিত হয়। কোনো রাসায়নিক সার ও কীটনাশক দেয়া হয় না। চাষিরা জানালেন, এখানে হেক্টরপ্রতি ১৫-১৬ টন পেয়ারা উৎপাদিত হয়। কিছু পেয়ারা বিদেশেও যাচ্ছে।
পেয়ারা ছাড়াও
মূলত জুন থেকে আগস্ট। এই তিন মাস পেয়ারার মওসুম। যখন পেয়ারা থাকে না। তখনো এখানকার কৃষকরা অন্য ফসল উৎপাদনে মনযোগী হন। কাগজি লেবু, আখ, শসা, সুপারি, আমড়া, কলা, গাছের চারা ইত্যাদি উৎপাদনে তারা ভালো করছেন খুব। বরিশালের আমড়া ও মিষ্টি আখের ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। কেবল পেয়ারা নয়। ভাসমান হাটে এসবও বিক্রি হয়। পেয়ারার মওসুম ছাড়াও এই হাট বসে। পেয়ারার পাশাপশি এখানকার কৃষকরা বোম্বাই মরিচ উৎপাদনে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন। জানা যায়, ২৮টি গ্রামের শত শত মানুষ বোম্বাই মরিচ চাষ করছেন। মওসুমে প্রতিদিন ৯-১০ ট্রাক দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। স্থানীয় চাষি রিপন জানালেন, পেয়ারার পাশাপশি বোম্বাই মরিচ চাষ করে তাদের ভালোই আয় হচ্ছে।

ভাসমান ও গাছের চারার হাট
নদ-নদী খাল-বিল বেষ্টিত দক্ষিণাঞ্চল। মানুষের জীবন-জীবিকায় খাল-বিল জড়িয়ে আছে ওতোপ্রোতভাবে। সরূপকাঠী থানার আদমকাঠীতে খালের মধ্যে বসে গাছের চারার হাট। ফলদ, বনজ, ফুলগাছের চারা বিক্রি হয়। পাইকাররা চারা কিনে ফরিদপুর, ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনাসহ বিভিন্ন স্থানে নিয়ে যায়। আষাঢ় থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত আটঘর কুড়িয়ানা, ইন্দেরহাটে ছোট নৌকার হাট বসে। কৃষিপণ্য তোলা বিক্রিতে এই নৌকা ব্যবহার বেশি হয় বলে জানা যায়। দৃষ্টিনন্দন এসব নৌকা বিক্রি করে ইলুহার, গাগর, আতাকোঠালী, বৈঠাকাটা গ্রামের অসংখ্য পরিবার জীবিকা নির্বাহ করছে। সরূপকাঠীর ১০ ইউনিয়নের প্রায় ১৩টি গ্রামের সহস্রাধিক পরিবার বংশপরম্পরায় নৌকা তৈরি করেন। ৭০০ থেকে পাঁচ হাজার টাকায় একটি ছোট নৌকা কিনতে পাওয়া যায় বলে জানা যায়।

হিমাগার আজো হয়নি
পেয়ারা পচনশীল দ্র্রব্য। পেকে গেলে সংরক্ষণ করতে হয়। নতুবা নষ্ট হয়ে যায়। পেয়ারাচাষিদের দীর্ঘ দিনের দাবি একটি হিমাগার স্থাপন করার। বিভিন্ন সময় বিভিন্ন জন আশ্বাস দিয়েছেন। কিন্তু হিমাগার আজো হয়নি। পেয়ারার জেলি দেশ-বিদেশে জনপ্রিয়। তাই আটঘর কুড়িয়ানা কিংবা ভীমরুলিতে জেলি কারখানা স্থাপন করা হলেও চাষিরা উপকৃত হতেন। তবে পাঁচ যুবক দুই একর জায়গার ওপর ন্যাচারাল ট্যুরিস্ট অ্যান্ড পিকনিক স্পট গড়ে তুলেছেন। সেখানে পর্যটকরা বিশ্রাম নিতে পারেন।
ছবি : লেখক

 


আরো সংবাদ



premium cement