২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

সঙ্গীতের নিপুণ কারিগর

-

‘একবার যদি কেউ ভালোবাসতো, আমার নয়ন দু’টি জলে ভাসতো, আর ভালোবাসতো।’ আমি যখন সৈয়দ আব্দুল হাদীর কণ্ঠে এই গান রেডিওতে শুনেছি, তখন বুঝিনি গানটির ভাবের গভীরতা। যখন বুঝলাম তখন ভাবলাম আহা, কি গান! এমন গান বাংলাদেশে, কে সেই বিখ্যাত সুরকার? গানের সুর অনেকেই করেন, কারো কারো সুরের গান দেশ-কাল-সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বজনীন ও কালজয়ী হয়ে যায়। যিনি সুর করেন তাকে সুরকার বলা হয়, গানের সুর যদি শিল্পের পর্যায়ে পড়ে তখন সেই সুরকারকে সুরশিল্পী, সুরস্রষ্টা বলা হয়। প্রয়াত সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক আলাউদ্দীন আলী একজন সুরস্রষ্টা ছিলেন। প্রখ্যাত চলচ্চিত্র পরিচালক আমজাদ হোসেন নির্মিত সিনেমায় আলাউদ্দীন আলীর সুর ও সঙ্গীত আয়োজনে সৈয়দ আব্দুল হাদী, সাবিনা ইয়াসমিন গান গাইলেই সেই সময় গানটি সাধারণত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেতো। আলাউদ্দীন আলী নিজ কর্ম গুণেই হয়েছেন স্মরণীয়। ২০২০ সালে আমাদের ছেড়ে চলে গেলেন সঙ্গীতজ্ঞ আজাদ রহমান, কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোর এবং সর্বশেষ সুরস্রষ্টা আলাউদ্দীন আলী। একই বছরে আমাদের সঙ্গীতজগতে বারবার আঘাত! কালজয়ী মানুষদের এভাবে চলে যাওয়া আমাদের সঙ্গীতাঙ্গনে গভীর শূন্যতা সৃষ্টি করল।
আলাউদ্দীন আলী মূলত বেহালা বাদক ছিলেন। তিনি ষাটের দশকে বেহালা বাদক হিসেবে চলচ্চিত্রে কাজ শুরু করেন, এ ছাড়াও টেলিভিশন ও বেতারে সুরকার হিসেবে নিয়মিত ছিলেন। ‘ও আমার বাংলা মা তোর’.... লিনু বিল্লাহ ও পরে সাবিনা ইয়াসমিনের গাওয়া এই গানটি তার টেলিভিশনের জন্য প্রথম সুর করা গান। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের গানে শহীদ সুরকার আলতাফ মাহমুদ ও প্রখ্যাত সুরকার আনোয়ার পারভেজের সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। ‘সন্ধিক্ষণ’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনার মধ্যে দিয়ে আলাউদ্দীন আলী চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা শুরু করেন। এরপর তিনি ‘গোলাপি এখন ট্রেনে, ফকির মজনু শাহ’ চলচ্চিত্রে সঙ্গীত পরিচালনা করলে তার সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। আলাউদ্দীন আলী বাংলাদেশ চলচ্চিত্র, বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন মিলে প্রায় পাঁচ হাজার গানের সুর সৃষ্টি করেছেন। এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই..., আছেন আমার মোক্তার আমার বারিস্টার..., আমায় গেঁথে দাওনা মাগো একটা পলাশ ফুলের মালা..., শত জনমের স্বপ্ন তুমি আমার জীবনে এলে..., কি করে বলিব আমি আমার মনে বড় জ্বালা...., ভালোবাসা যত বড় জীবন তত বড় নয় ..., চোখের নজর এমনি কইরা ..., যেটুকু সময় তুমি থাকো কাছে মনে হয় এ দেহে প্রাণ আছে..., যে ছিল দৃষ্টির সীমানায়..., একবার যদি কেউ ভালোবাসতো..., সূর্যোদয়ে তুমি সূর্যাস্তেও তুমি..., বন্ধু তিন দিন তোর বাড়িত গেলাম..., জন্ম থেকে জ্বলছি মাগো..., সুখে থাকো ও আমার নন্দিনী হয়ে কারো ঘরনী..., একা একা কেন ভালো লাগে না...., এই গানগুলো সুরস্রষ্টা আলাউদ্দীন আলীকে অনন্য উচ্চতায় আসীন করেছে।
আলাউদ্দীন আলী ছিলেন সঙ্গীতের নেপথ্য নায়ক। তার জীবনের প্রথম সুর করা গানটি ছিল দেশাত্মবোধক। আলাউদ্দীন আলী বাংলা ধ্রুপদী ও লোকজ গান ব্যবহার করে আধুনিক গানের এক নতুন ধারা সৃষ্টি করেছেন। তার ছোঁয়ায় বাংলা সিনেমার গান ধন্য হয়েছে। তার গান সব শ্রেণীর দর্শকের হৃদয় নাড়া দিয়েছে। তবুও সুরকার আলাউদ্দীন আলী নিজ কণ্ঠে ‘ফকির মজনু শাহ’ সিনেমায় গাইলেন ‘কিবা যাদু জানো বন্ধু’ সেই সময় গানটি দর্শক নন্দিত হয়েছিল।
কেউ তাকে কোনো দিন কথা দেয়নি। কেউ তাকে ভালোবাসলে তার নয়ন জলে ভাসতো। সময় হয়েছিল তবুও তিনি ফিরে যেতে চাননি। তবে তাকে যেতে হয়েছে চিঠি এসেছিল বলে! তার পিঞ্জর ভেঙেছিল, তবুও তিনি ডানা মেলেছিলেন। এরপরও তার মতো কেউ সুখী ছিল? ভালোবাসা তার কাছে জীবনের চেয়ে বড় ছিল তাইতো তিনি বদনামের ভয় করেননি, বিনি সুতার মালা গেঁথেছেন। সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক সুরস্রষ্টা আলাউদ্দীন আলী, এর বাইরে তিনি গীতিকার ও গায়ক হিসেবেও সমাদৃত।

 


আরো সংবাদ



premium cement