২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

চারণ কবি অমর চন্দ্র সরকার

চারণ কবি অমর চন্দ্র সরকার -

কবিগান আমাদের লোকসাহিত্যকে যেমন সমৃদ্ধ করেছে, তেমনি লোকশিক্ষায় রেখেছে মূল্যবান অবদান। বাঙালির প্রাণের সামগ্রী ও বাস্তব জীবানুভূতিসম্পন্ন লোকায়ত কবিগান গ্রামীণ মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনার সামগ্রিক পরিমণ্ডল ব্যাপ্ত করে অবস্থান নিয়েছে। দেশপ্রেম আর মানবপ্রেম নিয়ে কবিগানে প্রচুর আলোচনা হয়। ভালো আর মন্দের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে মানুষের চিন্তাজগতকে আলোড়িত করে এসব কবিগান। প্রকৃতি, পরিবেশ, নৈসর্গিকতা নিয়েও কবিগানে যথেষ্ট আলোচনা হয়। তবে সবার উপরে অসাম্প্র্রদায়িকতার বিষয়টি কবিগানে বরাবর বহুলচর্চিত ও গীত হয়েছে।
তেমনি একজন সঙ্গীত সাধক দেশের অন্যতম চারণ কবি মানিকগঞ্জের অমর চন্দ্র সরকার। পল্লী অঞ্চলের তৃণমূল মানুষের সুখ-দুঃখের কাহিনী গানের মাধ্যমে তুলে ধরে মানুষের দেশপ্রেম, মানবতা জাগ্রত ও সচেতনতায় কবি অমর সরকারের অবদান অপরিসীম। সুদীর্ঘ চার যুগেরও বেশি সময় ধরে কবিগানের ছন্দে-আনন্দে জয় করছেন দেশের আনাচে কানাচের অগণিত ভক্ত দর্শক শ্রোতাদের।
ঘিওর উপজেলার জাবরা গ্রামে ১৯৫৪ সালে জন্ম এই সঙ্গীত সাধকের। নিয়মিত গান পরিবেশন করছেন বাংলাদেশ বেতার ও বেশ কয়েকটি টেলিভিশনে। কবিগান ছাড়াও তিনি বাংলা নাটক ও চলচ্চিত্রে অভিনয় জগতেও রেখেছেন কৃতিত্বের সাক্ষর। বেশ কয়েকটি অডিও অ্যালবামও রয়েছে তার। তার স্বরচিত কবিগানের সংখ্যাও শতাধিক। লোকসংস্কৃৃতিতে সামগ্রিক অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন শিল্পকলা সম্মাননা, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যতত্ব বিভাগের সূর্যবরণ পুরস্কার, উদীচী, জেলা প্রশাসক অ্যাওয়ার্ডসহ নানা সম্মাননা পুরস্কার। তার বাবার নাম রাখাল চন্দ্র সরকার এবং মা কৌশলা রানী সরকার। পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে অমর সরকার তৃতীয়। ব্যক্তি জীবনে অমর সরকারের স্ত্রী আরতী রানী সরকার, ছেলে দুলাল চন্দ্র সরকার, পুত্রবধূ মায়া রানী সরকার ও মেয়ে সবিতা সরকারকে নিয়েই তার সংসার।
এসএসসি পাস করার সাথে সাথেই তার চাকরি হয় সিঙ্গাইরের এক বিদ্যালয়ে। কিন্তু শিক্ষকতা তার আর করা হয়ে ওঠেনি। কর্মস্থল নিজ বাড়ি থেকে বেশ দূরে এবং অন্যের বাড়িতে জায়গির থেকে চাকরি করা তার মন টেকেনি। একদিন বানিয়াজুড়ি নিজ বিদ্যালয় আঙিনায় এক অনুষ্ঠানে আয়োজন করা হয় কবিগানের আসর। খুব নিবিড়ভাবে দর্শন করেন সেই কবিগানের পালা। মনে গেঁথে যায় তার। তিনি কবিগানের শিল্পী হবেন এমন দৃঢ় সংকল্পে শুরু করেন পথচলা। কবিয়াল, আধ্যাত্মিক ও দেহতত্ত্ব সঙ্গীতের অমর রূপকার রাধা বল্লøভ সরকারের অন্যতম শিষ্য জগদীশ চন্দ্র সরকারের বাইতরা গ্রামের বাড়িতে তালিম নেন চার বছর। এরপর ওস্তাদের নির্দেশক্রমে প্রথম গানের আসরে কবিগান পরিবেশন করেন মানিকগঞ্জের ভাটবাউর এলাকায়। কবিগানের জটিল তত্ত্বের ব্যাখ্যা, সুর ও ছন্দের মিতালীর সাথে নানা ঢঙে তার পরিবেশিত সেই গান শুনে সঙ্গীতগুরু তার মাথায় হাতের পরশ বুলিয়ে আশীর্বাদ করেছিলেন। তারপর আর কবি অমর সরকারকে পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। একের পর এক গানের বায়না আসতে লাগল। ছুটে চললেন দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। সুদীর্ঘ চার যুগেরও বেশি সময় ধরে চলে আসছে তার এ পথচলা। কবিগানের ছন্দে-আনন্দে জয় করছেন দেশের আনাচে কানাচের ভক্ত দর্শক শ্রোতাদের। এমনকি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অগণিত মানুষের মাঝেও রয়েছে অমর সরকারের ব্যাপক জনপ্রিয়তা।
করোনার এই দুঃসময়ে ভালো নেই কবি, বাউল, পালাগানের শিল্পীরা। কতদিন ধরে, কোথাও গানের আয়োজন নেই। বন্ধ হয়ে গেছে আয়-উপার্জনের মাধ্যম। চারণকবি অমর সরকার অনেকটা আক্ষেপের সুরেই বললেন, নিদারুণ কষ্টে আছেন তৃণমূলের এসব শিল্পী। কেউ কেউ ধারদেনায়ও জড়িয়ে পড়েছেন। অনেকেই বদলে ফেলছেন এই পেশা। করোনাকালে সরকারি-বেসরকারি অনেক মানবিক সহায়তা কর্মসূচি চালু থাকলেও বেশির ভাগ শিল্পীর ভাগ্যেই জুটেনি কোনো সহায়তা। এই দুঃসময়ে তাদের পাশে দাঁড়ালে, তাদের কষ্ট কিছুটা হলেও লাঘব হবে, এমন প্রত্যাশা এই গুণী কবিয়ালের।
মনোমুগ্ধকর পরিবেশন লোকজনকে কবিগানের প্রতি সহজাতভাবেই আকৃষ্ট করে। তবে আকাশ সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতির প্রভাবে এই সম্প্রদায় এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তৃণমূল কবিয়ালদের সংগঠন প্রতিষ্ঠা করে, তাদের আবেদন-নিবেদন যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অবগত করার গুরুত্বও দিলেন কবি অমর চন্দ্র সরকার। ঐতিহ্যবাহী কবিগান এখন বিলুপ্তপ্রায়। একসময় গ্রামে গ্রামে নিয়মিত এর আয়োজন হলেও এখন সচরাচর চোখে পড়ে না। পৌষের শীতে মঞ্চের সমানে উৎসুক দর্শদের ভিড়। সেই মঞ্চে গভীর রাত পর্যন্ত দুই কবিয়ালের মধ্যে চলে বাক আর তর্ক-বিতর্কের যুদ্ধ। মন্ত্রমুগ্ধের মতো নির্ঘুম রাত কাটে দর্শকদের। যেন ভাবনা ছুঁয়ে গেছে আকাশের চাঁদকেও...কবিগানের এ দৃশ্য এখন শুধুই কাল্পনিক। সময়ের সাথে সাথে এ সব দৃশ্যও যেন আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। আধুনিকতার ছোঁয়ায় মঞ্চে হ্যাজাক লাইটের আলো না থাকলে থাকে বৈদ্যুতিক আলোর ঝলকানি। কিন্তু তারপরও শিকড়সন্ধানী কিছু মানুষ এখনো এ কবিগানকে খুঁজে বেড়ায় মনের অজান্তে। হারিয়ে যাওয়া এ স্মৃতির দৃশ্যে কিছুটা সময়ের জন্য হলেও খুঁজে পান সেই আনন্দ। প্রথম দলের কথাকে বলা হতো ‘চাপান’, আর দ্বিতীয় দলের কথাকে বলা হতো ‘উতোর’। পাঁচালি, খেউড়, আখড়াই, হাফ-আখড়াই, বসা কবিগান, দাঁড়া কবিগান, ঢপ, টপ্পা, কীর্তন, তর্জা প্রভৃতি ছিল কবিগানের বিভিন্ন ধরন। এ সব পদ্যে রুচির খুব একটা চিহ্ন থাকত না। একে অন্যকে কথার আক্রমণে পর্যুদস্ত করে ক্ষণিকের আনন্দ লাভই ছিল মূল লক্ষ্য।
কবিগানের এমন দৃশ্য চিরকালীন। যদিও সময়ের সাথে কবিগান গ্রামবাংলা থেকে হারিয়ে যেতে বসেছে। কিন্তু তারপরও শিকড়সন্ধানী কিছু মানুষ এখনো ফিরে যেতে চান সোনালি অতীতে। কবিগানের মধ্যেই খুঁজে বেড়ান আপন সংস্কৃতি। মনের আনন্দ। গ্রামবাংলার ঐতিহ্য কবিগানকে এখনো আগলে রেখেছেন মানিকগঞ্জের অমর চন্দ্র সরকার। প্রত্যন্ত পল্লøীগুলোতে যেসব শিল্পী এসব গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন, ভালো নেই তারা। মনের টানে সুস্থ সংস্কৃতি ধারাকে ধরে রাখলেও অযতœ, অবহেলা আর সংরক্ষণের অভাবে হারিয়ে যেতে বসেছে কবিগানের পালা। সরকারি-বেসরকারি প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা এবং বাঙলা আদি লোকজ সঙ্গীতের সঠিক মূল্যায়ন করলেই দীর্ঘ দিন টিকে থাকবে কবিগানের আসর এবং এ পেশার সাথে জড়িত শিল্পীরা।


আরো সংবাদ



premium cement