২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

দেবাশীষের সফলতা লাভবার্ডে

-

শখ করে মানুষ কত কিছুই না করে। অনেকের মতোই দেবাশীষ বড়–য়া জোসির শখ পোষা পাখি লাভবার্ড পালন। লাভবার্ডের সাথে তার পরিচয় ১৯৯৯ সালে। অল্প দিনেই তিনি লাভবার্ড পালনে ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন। তার খামারে উৎপাদিত হচ্ছে আন্তজার্তিক মানের লাভবার্ড। শখ থেকে এখন তার আয় হচ্ছে ভালোই। পোষা পাখির জগতে দেবাশীষ এখন অনেকেরই অনুকরণীয় ব্যক্তি। তার থেকে লাভবার্ড বেবি, বুদ্ধি, পরামর্শ নিয়ে অনেকেই সফলতার মুখ দেখেছে। তিনি গত এক বছরে আনুমানিক ২৫ জোড়া ফিশার প্রজাতির লাভবার্ড থেকে প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ পিস বাচ্চা উৎপাদন করতে পেরেছেন। প্রতি মাসে তার সব খরচ বাদে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মতো মুনফা থাকে। পাখির প্রতি প্রেম তার ছোটবেলা থেকেই। অসংখ্য অসুস্থ পাখির সেবা করে সুস্থ করেছেন। ঝড়, বৃষ্টি হলে খুঁজে বেড়াতেন কোথাও পাখির বাচ্চা পড়ে আছে কিনা। তখন চতুর্থ শ্্েরণীতে পড়েন। শিকারির আঘাতে রক্তাক্ত বুলবুলির বাচ্চা খুঁজে পান। পরম মততা, সেবা দিয়ে তাকে সুস্থ করে তোলেন। কবুতর, ময়না, শালিক, ঘুঘু, টিয়া এমন অনেক পাখি পালন করেছেন। ১৯৯৯ সালে তিনি লাভবার্ড পালা শুরু করেন। কাটাবন থেকে তিন তিনবার লাভবার্ড কেনেন। এ পাখি আটটা-দশটা করে ডিম দেয়। কিন্তু বাচ্চা আর হয় না। হবেইবা কিভাবে। দুটা পখিই তো ফিমেইল। ২০০৫ সালে তিনি প্রথম লাইম ফিচার লাভবার্ডের বাচ্চার মুখ দেখেন। ছয় বছর শুধু ধৈর্য ধরেছেন। এ প্রসঙ্গে জোসি বলছিলেন, শুধু ধৈর্য থাকার কারণে আজকে লাভবার্ড সেক্টরে আমি অনেক সফল হয়েছি। তার পাখির খামারের নাম বার্ডস গার্ডেন এভিয়ারি। এই পক্ষীশালায় প্রায় ৪০ জোড়া ব্রিডিং (বাচ্চা করার উপযোগী) লাভবার্ড আছে। উল্লেখযোগ্য প্রজাতিগুলো হলো, ব্ল অপলাইন ফিশার, গ্রিন অপলাইন ফিশার, পেইড ক্লিয়ার হেডেড পারব্লু, ইয়েলো ফিশার, ইয়েলো ফেস পার ব্লু, পেইড ব্লু সেবল, কোবাল্ট সেবল, লুটিনো পিচ ফেস, রোসি পিচ ফেস, ডি এফ ইয়েলো হেড পার ব্লু ইত্যাদি। প্রায় ১৫টি প্রজাতির লাভবার্ডের বাচ্চা করতে সফল হয়েছেন। যেগুলো হলো, পেইড ডিএফ ভায়োলেট স্যাবল, পেইড ক্লিয়ার হেডেড পারব্লু, ডিএফ ভায়োলেট ক্লিয়ার হেডেড পারব্লু, ডিএফ ইয়োলো ফেস পারব্লু, ইয়োলো ফিশার, গ্রিন ফিশার, ডিএফ ভায়োলেট ফিশার, ডিএফ ভায়োলেট স্যাবল, পেইড ডিএফ ভায়োলেট পেইড স্যাবল, পেইড ব্লু স্যাবল, হোয়াইট ফিশার, ডিডি ব্লু ফিশার, ডিডি কোবাল্ট ফিশার, কোবাল্ট স্যাবল, লুটিনো পিস ফেস, রোজি পিচ ফেস। জোসি জানালেন, গত এক বছরে অনুমানিক ২৫ জোড়া ফিশার প্রজাতির লাভবার্ড থেকে প্রায় ৩০০ থেকে ৩৫০ পিস বাচ্চা উৎপাদন করতে পেরেছেন। প্রতি মাসে তার সব খরচ বাদে ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকার মতো মুনফা থাকে।
লাভবার্ড ডাকাডাকি করে। পাশের বাসার অসুবিধা হয়। এরকম অভিযোগ এলো। তখন জোসির ঘরে বাচ্চাসহ লাভবার্ড। কোথায় যাবেন। বাড়িওয়ালা নিচতলায় একটা রুম দিলেন। সেখানে কিছু দিন থাকলেন। পরে তাও ছেড়ে দিতে হলো। বাসায় মধ্যে পাখি থাকবে। শুনে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না। আবার আমদানি করা নিম্নমানের কমদামি লাভবার্ডে বাজার সয়লাব। এমন শত সমস্যা তো ছিলই। সব কিছুই জোসির লাভবার্ড প্রেমের কাছে হেরে গেছে। তিনি এইচআরএমএ এমবিএ, পিজিডি করেছেন। বেশ কিছু দিন একটি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। এখন পারিবারিক ব্যবসা দেখাশোনা করছেন। ব্যবসা করলে ভালোবাসার পাখিকে বেশি সময় দেয়া যাবে। সে কারণে চাকরি তাকে ধরে রাখতে পারেনি। জোসির কাছে প্রশ্ন রেখেছিলাম, বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজাতির পোষা পাখি আছে। লাভবার্ড মানুষ পালন করবে কেন? তিনি বললেন, লাভবার্ড দেখতে সুন্দর। পালন করা সহজ। অসুখ বিসুখ কম। অসুখ হলেও চিকিৎসা করার মতো সময় দেয়। শক্ত প্রজাতির পাখি। খাবার, ওষুধ সব সহজলোভ্য। আয়ুকালও বেশি। খাঁচায় প্রায় ১৫০ ১২ বছর বাঁচে। প্রজাতির সংখ্যা বেশি। আমাদের দেশের আবহাওয়া এদের জন্য খুব উপযোগী। লাভবার্ড যখন বাসা বানায়। মেইল পাতা কেটে দেয়। ফিমেইল পাখনার নিচে করে হাঁড়িতে নিয়ে যায়। আবার কিছু প্রজাতির ফিমেইল পাতা পানিতে ভিজিয়ে তারপর নিয়ে যায়। ফিমেইল যখন ডিমে তা দেয়। মেইল তখন তাকে মুখে তুলে খাইয়ে দেয়। হেলিকপ্টারের ডানার মতো ফিমেইল পাখা মেলে ডিমে তা দেয়। লাভবার্ড ছেলে মেয়ে একে অপরের গা খুঁটে দেয়। এসব সত্যিই দেখার বিষয়। জোসি আরো বলছিলেন, বাসা বানানো, ডিম দেয়া, বাচ্চা ফুটে বেরিয়ে আসা এই পুরো প্রক্রিয়াটা আমার খুব ভালো লাগে। তবে ডিমের মধ্যে অনেক সময় বাচ্চা মারা যায়। যেটাকে বলে ডেড ইন সেল। তখন জোসির খারাপ লাগে। আবার সঙ্গী পছন্দ না হলে খুব ভয়ঙ্করভাবে মারামারি করে। একে অপরকে মেরেও ফেলতে পারে। ছোট বাচ্চা যখন বড় হয়। অনেক মা, বাবা তাদের পালকগুলো তুলতে থাকে। যেটাকে বলে ফেদার প্ল্যাকিং। শখের বসে স্টুডেন্ট, গৃহিণী, অবসরপ্রাপ্ত চাকরিজীবিরা দু-এক জোড়া লাভবার্ড অনায়াসে পালন করতে পারেন। লাভবার্ড পালন করে পকেট খরচের টাকা সংগ্রহ করেন এমন ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা আমাদের দেশে কম নয়। জোসির কাছে এ তথ্য জানা গেল। পোষাপাখি লাভবার্ড পালনে সামাজিক সুফলও অনেক। পাখি পালন নেশা থেকে বাঁচায়। গ্যাজেট আসক্তি কমায়। অবসরকে আনন্দময় করে তোলে। নতুনদের জন্য জোসির পরামর্শ হলো যে কোনো দেশী ভালো ব্্িরডার থেকে লাভবার্ড সংগ্রহ করতে হবে। জোসির মামা ডাক্তার প্রদীপ কুমার চৌধুরী,আন্টি ডাক্তার ফাহমিদা তোফয়েল (মিমি)। এই দু’জন বার্ডস গার্ডেন এভিয়ারি করার অনুপ্রেরণা দিয়েছেন। সব সময় সহযোগিতা করেন বলে তিনি জানান। মা বন্ধনা বড়–য়া, স্ত্রী মৈত্রী বড়–য়া সব প্রয়োজনে পাশে থাকেন। জোসি বললেন, লাভবার্ড বিক্রি করে স্ত্রীকে ঘড়ি, মোবাইল উপহার দিয়েছি। পরিবার যেমন জোসির পাশে থাকেন। জোসির তেমনি যাদের কাছে পাখি বিক্রি করেন। তাদের সবরকম সহযোগিতা প্রদান করেন। পাখির জগতে আফটার সেলস সেবায় তিনি এক অনন্য দৃষ্টান্ত বলে অনেকেই মনে করেন। ফেসবুকে তার পেজ বার্ডস গার্ডেন এভিয়ারি পাখি বিক্রির মাধ্যম। এছাড়া লাভবার্ড রিচার্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট গ্রুপে এডমিন তিনি। এখানে তিনি লাভবার্ড পালকদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দেন। নতুনদের দিকনির্দেশনা দেন। বিদেশী পোষাপাখি বাংলাদেশে উৎপাদিত হবে। একসময় ভাবাও যেত না। জোসির মতো উদ্যমী তরুণরা কেবল উৎপাদন নয়। এখন রফতানি করার কথা ভাবছেন। নিজের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জোসি বললেন, ভবিষ্যতে আমি লাভবার্ডের বড় একটা খামার করব। পাশাপাশি একটা ট্্েরনিং স্কুল প্রতিষ্ঠা করব। যেন লাভবার্ড বিষয়ে হাতে কলমে মানুষ প্রাথমিক ধারণা, মিউটেশন, চিকিৎসা ইত্যাদি বিষয়ে জানতে পারে।

 


আরো সংবাদ



premium cement