২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

করোনাদিনে উৎসব

চারাগল্প
-

যুগে যুগে বিভিন্ন মহামারীতে মানবসমাজ বিপন্ন ও বিপর্যস্ত হয়েছে। করোনা মহামারীতে আতঙ্কিত গোটা বিশ্ব। করোনা বা ২০১৯- এনসিওভি নামক ভাইরাসটির প্রথম প্রাদুর্ভাব ২০১৯ সালের ডিসেম্বর মাসে চীনের উহান নগরীতে। ২০২০ সালের ১১ মার্চ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা রোগটিকে একটি বৈশ্বিক মহামারী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। কারণ রোগটি দ্রুত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ২ আগস্ট ২০২০ সালের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বিশ্বের ২১৩টির বেশি দেশে কোভিড-১৯ মহামারী ছড়িয়েছে। নিশ্চিত আক্রান্তের সংখ্যা এক কোটি ৭৮ লাখ ৫৯ হাজার ৭৬৩ জন এবং মারা গেছেন ছয় লাখ ৮৫ হাজার ১৭৯ জন। বাংলাদেশে আক্রান্তের সংখ্যা দুই লাখ ৪০ হাজার ৭৪৬ জন এবং মৃত্যুবরণ করেছেন তিন হাজার ১৫৪ জন। করোনাকালের শেষ হচ্ছেই না। দুঃসময় যেন অক্টোপাসের মতো আঁকড়ে ধরেছে ।
করোনার মাঝেই জীবন চলছে জীবনের নিয়মে। বাঙালি জাতির জীবনের সাথে বিভিন্ন উৎসব ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এ উৎসবগুলো বাঙালি জীবনে আনন্দের ছোঁয়া নিয়ে আসে। সবাই তখন দুঃখ ও হতাশার গ্লানি ভুলে মেতে ওঠে অনাবিল আনন্দে। উৎসবপ্রিয় বাঙালি জাতির ১২ মাসে ১৩ পার্বণের ঘনঘটা। আর এই করোনাকালীন সময়ের মধ্যেই এসেছে বাঙালির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ধারণ করা বাংলা নববর্ষ। মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে ধর্মীয় দুটি প্রধান উৎসব ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহা উদযাপিত হয়েছে করোনা মহামারীর মধ্যে। ১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী, ২৬ মার্চ ছিল দেশের স্বাধীনতা দিবস। বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ সরকার ২০২০-২১ সালকে মুজিববর্ষ হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত দেয়। উৎসবগুলো যেভাবে উদযাপন করার পরিকল্পনা ছিল তা করোনার জন্য বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। করোনায় জনসমাগম এড়িয়ে চলার নিমিত্তে প্রধানমন্ত্রী মুজিবশতবর্ষের অনুষ্ঠান স্থগিত করেন। স্বাধীনতা দিবসের কুচকাওয়াজের আয়োজনসহ সব সভা-সমাবেশ বাতিল করা হয়।
বাংলা ১৪২৬ সালকে বিদায় জানিয়ে বর্ষপঞ্জিতে যুক্ত হয়েছে নতুন বছর ১৪২৭। প্রতি বছর পয়লা বৈশাখে দেশ বর্ণিল উৎসবে মাতলেও এ বছর কোনোরকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই নতুন বছরকে বরণ করতে হয়েছে। করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে পয়লা বৈশাখে লোকসমাগমের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে সরকার।
লকডাউনের মধ্যে এবার ঘরে বসেই পালিত হয়েছে মুসলিম ধর্মাবলম্বীদের অত্যন্ত প্রিয় এবং অন্যতম প্রধান ধর্মীয় উৎসব ঈদুল ফিতর। এবারের রমজান একেবারেই অন্যভাবে কেটেছে। ইফতারের পসরা সাজিয়ে বিক্রেতারা বসতে পারেনি। তারাবিহ নামাজ মুসল্লিøরা ঘরেই আদায় করেছেন। ঈদুল ফিতর এবং ঈদুল আজহার নামাজের জামাত অনুষ্ঠিত হয়েছে বিশেষ ব্যবস্থায় পর্যাপ্ত দূরত্ব মেনে। ঈদের দিনগুলোতে সবাই মিলে একসাথে নামাজ পড়া, আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়ি যাওয়া, ঘুরেফিরে আনন্দ করা হয়নি। এবার ঈদুল আজহায় অনেকেই বন্যা ও করোনার কারণে কোরবানি দিতে পারেননি। গত বছরের তুলনায় এবার কোরবানি দাতা ছিলেন প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি। কোরবানি না দিতে পারায় উৎসবের আমেজ ম­ান ছিল। সাদামাটা ঈদ উদযাপনে সীমাবদ্ধ ছিল এবারের ঈদুল আজহা। অর্থনৈতিক মন্দা আর প্রতিকূল পরিস্থিতি ভালোভাবেই কোরবানি ঈদে প্রভাব ফেলেছে। করোনার দুঃসময় অন্যান্যবারের তুলনায় এবারের ঈদগুলোকে নিষ্প্রভ করে তুলেছে।
একদিকে মহামারী করোনার দুর্যোগ, অন্যদিকে ভারত ও বাংলাদেশে হানা দিয়েছিল ঘূর্ণিঝড় আমফান। আমফানের কারণে বাংলাদেশের ২৫টি জেলার দেড় কোটি মানুষ কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কমানোর লক্ষ্যে সরকার তৎপর ছিল। বিপুলসংখ্যক মানুষকে আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে আনা হয়। তবু সরকারি হিসাবে ১৬ জন মানুষ আমফানে মৃত্যুবরণ করেছে। বাংলাদেশে আমফানে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল সাড়ে এগারো শ’ কোটি টাকা। একদিকে করোনায় বিপর্যস্ত জীবন, অন্যদিকে শুরু হয়েছে বন্যার তাণ্ডব। সরকারি হিসাবে দীর্ঘস্থায়ী বন্যায় প্রায় অর্ধকোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত। করোনাভাইরাস প্রকোপের মাঝে বন্যার্তরা চরম অসহায় পরিস্থিতিতে রয়েছেন। ৩১টি জেলায় করোনাভাইরাস এবং বন্যার মতো দুটি দুর্যোগ একসাথে মোকাবেলা করা বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
করোনায় প্রবাসীদের আয় কমে গেছে। বিদেশে অনেকে কাজ হারিয়ে বেকার হয়ে পড়েছেন। ফলে তারা দেশে টাকা পাঠাতে পারছেন না। অনেক প্রবাসী শ্রমিককে বিশেষ ব্যবস্থায় দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। অনেকে দেশে ফেরার অপেক্ষায় প্রহর গুনছেন। দেশেও কাজের সংস্থান নেই।
এত সংগ্রামের মাঝেও মানুষ বদলে যাওয়া জীবনের সাথে মানিয়ে নিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। শৃঙ্খলা মেনে ও সাবধানতার সাথে পথচলা অব্যাহত রেখে জীবনে নতুন ফুল ফুটাতে হবে। সরকার বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রণোদনা দিচ্ছে। সরকারি ও বেসরকারিভাবে পরিকল্পনামাফিক এগিয়ে গেলে এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে চললে থমকে যাওয়া জীবনের চাকা নতুন স্বাভাবিকতায় ঘুরিয়ে দিতে আমরাই পারব।


আরো সংবাদ



premium cement