২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ফ্রিজ

চারাগল্প
-

আমাদের অতীত ছিল অভাবের। অভাবের কাছে আমরা এতটাই কাবু ছিলাম যে প্রতি ঈদে কোরবানি দেয়া তো দূরের কথা, সস্তা দরের ঈদের জামাও পেতাম না। সবল দুটি পায়ে রিকশার প্যাডেল চালানো আমাদের রিকশাওয়ালা বাবার ভাগ্যে কখনো কোরবানি দেয়ার সৌভাগ্য হয়নি। তাই বলে কিন্তু ঈদে আমরা গোশত রুটি না খেয়ে থাকিনি কখনো। আমাদের বিত্তবান যারা আত্মীয় ছিলেন, তারা ঠিকই আমাদেরকে ভুলে যেতেন না। নিয়ম করে পলিথিন মুড়িয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিতেন কোরবানির গোশত। মা বড় আয়োজন করে চুলোয় গোশত বসাতেন। গোশত রুটি খাবো বলে আমরা সব ভাইবোন চুলোর ধারে গোল হয়ে বসে থাকতাম কখন গোশত রান্না শেষ হবে, এই প্রতীক্ষায়।
সেবার ঈদে আত্মীয়দের পাঠানো গোশতের পরিমাণ এতই বেশি হয়ে গেল যে মা কিছু গোশত পলিথিনে মুড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘যা, এগুলো খানবাড়ির নাজমাদের ঘরে নিয়ে যা। নাজমার মা ফ্রিজে রেখে দেবেন। ওদের ফ্রিজটা বড়।’
কিন্তু নাজমার মা আমাকে ফিরিয়ে দিলেন। তাচ্ছিল্যে বললেন, ‘এগুলো আমাদের ফ্রিজে রাখা যাবে না। ফ্রিজ কিনে ভুল করেছি। তোদের মতো ছোট লোকেরা রোজ কিছু না কিছু ফ্রিজে রাখতে আসে।’ বাড়িতে এসে মাকে এ ঘটনা বলতেই মা কষ্ট পেলেন। মায়ের বিষণœ মুখটা দেখে আমার বুকটা ভেঙে গেল। আমরা নাজমাদের মতো বড়লোক নই। আমি যদি কোনো দিন বড়লোক হই, সবার আগে মাকে একটি ফ্রিজ কিনে দেবো।
২.
সময় গড়িয়েছে অনেক। কালের আবর্তে আমরা সব ভাইবোন আজ প্রতিষ্ঠিত। আমাদের সেই কুঁড়েঘরের ভিটায় এখন ডুপ্লেক্স ঘর। এখন আর ঈদে আত্মীয়রা আমাদের গোশত পাঠায় না। আমরাই আস্ত একটি গরু কোরবানি দেই। আর ফ্রিজ! সেটা অনেক আগেই কেনা হয়েছে। ফ্রিজের দিকে তাকালে খানবাড়ির নাজমার মাকে মনে পড়ে। মন তখন খুব খারাপ হয়। সামান্য একটি ফ্রিজ না থাকলে মানুষকে জীবনের কাছে কখনো কখনো বড় অসহায় হতে হয়। নাজমার মা অনেক আগেই আমাদের সেটা বুঝিয়ে দিলেন।
খানবাড়ির নাজমারা এখন ভাগ্যের কাছে হেরে যাওয়া মানুষ। অহঙ্কার পতনের মূলÑ এ কথা তাদের জীবনে সত্য হয়ে ধরা দিয়েছে। ওরা অভাবের স্রোতে তলিয়ে গেছে। শুনেছি ওদের এখন আর কোরবানি দেয়ার অবস্থাও নেই। আত্মীয়স্বজনরা ঈদে কোরবানির গোশত পাঠায়। যেভাবে এক সময় আমাদের আত্মীয়রা আমাদের জন্য পাঠাত।
গত বছর ঈদের দিনের অপরাহ্নে নাজমার ছোট ভাই জাবেদ গোশতের পলিথিন নিয়ে আমাদের বাড়ি এসে মাকে বলল, ‘আপনাদের ফ্রিজে এগুলো রেখে দিন। মা পাঠিয়েছে।’ দূর থেকে এই দৃশ্য দেখলাম। তাহলে নাজমাদের ঘরে এখন ফ্রিজ নেই! অথচ নাজমার মা একদিন আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছেন গোশত ফ্রিজে না রেখে। আজ সে কথা মনে হতেই মাকে ডেকে বললাম, ‘ওদের গোশত ফ্রিজে রেখো না মা। ওর মা একদিন আমাকে...।’ মা নরম সুরে বললেন, ‘তাতে কী হয়েছে বাবা! ওই অতীত ভুলে যা। জাবেদ, দাও গোশতগুলো। ফ্রিজে রেখে দেই।’ জাবেদ নিশ্চিন্তে গোশতের পলিথিন মায়ের হাতে দিয়ে চলে গেল। ওর মাও মানুষ। আমার মাও মানুষ। মানুষে মানুষে কত ব্যবধান।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।

 


আরো সংবাদ



premium cement