১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`
চারাগল্প

শ্রাবণ দিনে

-

ফুফু কী করছেন?
নীপা চড়কি চোখে তাকাল। আট-নয় বছরের মেয়ে। ফ্রকের বদলে কামিজ পরেছে। এই বয়সের মেয়েরা কামিজ পরলে কেমন বেখাপ্পা লাগে। সে আপ্রাণ চেষ্টা করছে যেন তাকে যুবতী মেয়ের মতো দেখায়। কিন্তু সেই চেষ্টায় কোনো লাভ হয়নি। ইশরাকে দেখাচ্ছে সাত বছরের শিশু মেয়েদের মতো। নীপার হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু হাসল না। সে বিচলিত ভঙ্গিতে তাকাল আকাশের দিকে। শ্রাবণ মাস। আকাশে ঘনঘটা মেঘ। যেকোনো সময় নেমে আসবে। সময়টা এখন মেঘলা না হয়ে রৌদ্রময় হলে ভালো হতো। অনেক দিন আগে নিউমার্কেট থেকে চিনেমাটির চারটা ফুলদানি কেনা হয়েছে। পুরো টাকাটা দেয়া হয়নি। বাকিটা দেয়ার জন্য বেশ কিছু দিন থেকেই মন উসখুস করছে। অনেক দিন সেই পথে যাওয়া হয় না বলে দেরি হয়ে যাচ্ছে। দোকানদার কী ভাবছে কে জানে! নীপারও অবাক লাগে, অপরিচিত কাস্টমারের কাছে এতগুলো টাকা বাকি রাখে কেউ? এখন যদি বাকি টাকাটা সে না দেয়! যদি বছর দুইয়ের মধ্যে নিউমার্কেট না যায় আর? তাহলে দোকানদার তার চেহারা ভুলে যাবে, বাকি ব্যাপারটাও মনে থাকবে না। এক দিনের দেখা মাত্র। এক দিনের দেখা-চেহারা মানুষ কতদিন আর মনে রাখে!
ইশরা তুই কোথাও যাবি?
না।
পড়তে বসবি এখন?
আমার তো পরীক্ষা শেষ।
আমার সাথে যাবি?
কোথায়?
তোকে চটপটি খাওয়াব, আইসক্রিমও খাবি।
হুঁম যাবো।
তোর মাকে বলে আয়। বলবি এক ঘণ্টা পর ফিরবি। দেরি হলে চিন্তা না করে।
কিন্তু আমার যে ম্যাডাম আসবে।
তুই তো বললি পরীক্ষা শেষ।
শেষই তো।
তাহলে ম্যাডাম আসবে কেন বলছিস?
মা আসতে বলেছে।
রিকশায় বসা ইশরার চোখমুখ উজ্জ্বল। আইসক্রিম খাওয়ার আনন্দে নাকি বাইরে ঘুরে বেড়াবার আনন্দে জানে কে! ইশরার মা একটি কাজ ধরিয়ে দিয়েছে। ফেরার সময় স্টিলের দুটি ডাল ঘুঁটনি কেনার কাজ। নিউমার্কেট এসে নীপা আগে নিজের কাজ সারতে সেই দোকানটির সামনে দাঁড়াল। সেলসম্যান ছেলেটিকে বাকি টাকার কথা বলতেই দোকানের ভেতর থেকে সুন্দর মতো এক যুবক বলল, আপনার নাম নীপা? গত মাসে চারটি ফুলদানি কিনেছিলেন?
নীপা অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ।
আপনার টাকা একজন দিয়ে দিয়েছে।
নীপা আগের চেয়ে আরও অবাক হয়ে বলল, কে?
নাম জানি না। তবে আপনার জন্য একটা ছাতা আর একটা কাগজ রেখে গেছে।
অদ্ভুত ভাবনা আর অনিচ্ছা সত্ত্বেও ছাতাটি হাতে নেয় নীপা। শুধু কাগজে এটুকুই লেখাÑ ফেসবুক মেসেঞ্জারটা খুললে খুশি হবো।
অনেক দিন হলো ফেসবুকে ঢোকে না নীপা। বাড়িতে এসেই লগ ইন করল। রহস্য জানার আগ্রহেই কিনা! অনেক মেসেজ এসে জমা হয়েছে। সবার মেসেজ পড়ল সে। হাই, হ্যালো, গুডনাইট, কেমন আছো, অনেক দিন দেখি না প্রভৃতির মেসেজের আড়ালে শুধু একজনের ব্যতিক্রম লেখাটা চোখে পড়লÑ ‘নীপা কেমন আছেন? আমার পরিচয় জানতে নিশ্চয়ই আপনার মন উতলা হয়ে উঠেছে। হওয়াই স্বাভাবিক। চার বছর ধরে অজানা অদেখা কেউ একজন প্রতি বছরের ঠিক শ্রাবণ মাস এলেই আপনাকে ছাতা পাঠায়। এমন ঘটনায় বিচলিত হওয়া খুবই স্বাভাবিক। আজ কিছু হলেও আপনার চিন্তার ভার নেবো। ঘটনাটা শুরু হয়েছিল কোনো এক শ্রাবণ মাসে। প্রচণ্ড বৃষ্টিতে ভিজে আমার অসুস্থ মাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে রাস্তায় দাঁড়িয়েছিলাম। হঠাৎ আপনি এসে আমার মায়ের মাথার ওপর ছাতা ধরলেন। এরপর কার ডাকে একবারও আমার দিকে না তাকিয়ে আমার হাতে ছাতা ধরিয়ে দিয়ে চটজলদি চলে গেলেন। সেদিন বুঝে ছিলাম অন্যের মায়েদের প্রতি আপনার তীব্র মায়া! অনেক কষ্ট করে চার বছর আগে আপনার নাম ঠিকানা বের করেছি। অবশ্য আপনার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট পেলাম মাত্র মাস দুই আগে। আপনি রাজি থাকলে আমাদের মাকে দেখাশোনার ভার আমরা দু’জনেই নিতে পারি।’
মেসেজ পড়ে নীপা হা হা করে হেসে ওঠে একা ঘরেই। কী অদ্ভুত প্রস্তাব! কিন্তু পরক্ষণেই তার ভেতরে অজানা ভালোলাগার তীব্র এক অনুভূতি স্পর্শ করল। সে এসে দাঁড়াল বারান্দায়। বৃষ্টির দিন। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে খুব। এখন তো শ্রাবণের দিন।
নবাবগঞ্জ, ঢাকা


আরো সংবাদ



premium cement