১৮ এপ্রিল ২০২৪, ০৫ বৈশাখ ১৪৩১, ০৮ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বুবু

চারাগল্প
-

বাবার মৃত্যুর পর আমাদের সংসারে অভাব শুরু হলো। অভাব দূর করার জন্য মা আমার ওপর সঠিক আস্থা রাখতে না পারার প্রধান কারণ হচ্ছেÑ আমার দায়িত্বহীনতা। সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব পালনে আমার অগ্রণী ভূমিকা না থাকলেও আড্ডাবাজিতে আমাকে কেউ ঠেকাতে পারে না। বাজারের বিভিন্ন চা দোকানে বেলায়-অবেলায় আমার আড্ডাটাও চোখে লাগার মতো। এসব আড্ডায় বন্ধুর তালিকা দিন দিন দীর্ঘ হতে লাগল। চায়ের কাপ থেকে তত দিনে সিগারেটেও সমান আসক্তি আমার। মা আমার বেগতিক অবস্থা দেখে কাঁদেন। সে কান্নাতে আমার মন গলে না। খেতে বসলে থালায় পছন্দের তরকারি না পড়লে ভাতশুদ্ধ পুরো থালা ছুড়ে মারতে দেরি করি না। ছুড়ে ফেলা সেসব ভাত কুড়াতে কুড়াতে স্বপ্না বুবু একদিন সিদ্ধান্ত নেয় সে চাকরি করবে।
মেয়ের চাকরির কথা শুনে মায়ের জোরালো আপত্তি। কিন্তু স্বপ্না বুবু মাকে বুঝিয়ে বলল, ‘চিন্তার কিছু নেই। কাজটা বিউটি পার্লারে। বউ সাজানো। এই কাজ সবাই পারে না। বাজারের সাজ পার্লারের রোজি আপার সাথে কথা বলেছি। তার পার্লারের বউ সাজানোর দায়িত্ব এখন থেকে আমার। মাস শেষে ভালোই পয়সা দেবে। কালই যোগ দেবো।’ আমতা আমতা করে মা শেষ পর্যন্ত মেনেই নিলেন। পরদিন থেকে স্বপ্না বুবু সাজ পার্লারে যাওয়া শুরু করল। সকালে যায় তো ফেরে সন্ধ্যায়।
আমার স্বপ্না বুবু। বয়স ত্রিশের কাছাকাছি। বিয়ের ছয় মাস পর বিধবা হলো। ইকবাল ভাই শহরে নিখোঁজ হওয়ার দু’দিন পর খবরের কাগজে যে সাতজনের লাশের ছবি দেখল দেশবাসী, তাদের মধ্যে একটি লাশ ছিল ইকবাল ভাইয়ের। বাস-ট্রাকের সংঘর্ষে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে। ছয় মাস সংসার করে বিধবা হয়ে আমাদের কাছে চলে এলো স্বপ্না বুবু।
দিন যেতে থাকে। রোজ সকালে স্বপ্না বুবু পার্লারে যায়। ফেরে সন্ধ্যায়। রোজি আপা ভালো বেতন দেয়। সে বেতনে আমাদের সংসার থেকে অভাব পুরোপুরি দূর হয় না। মা প্রায়ই আমাকে ধমক দিয়ে বলেন, ‘বেকার হয়ে বোনের রুজি খাচ্ছিস! লজ্জা করে না!’
২.
চার মাস পরের ঘটনা। মেঘাচ্ছন্ন বিকেল। দুনিয়া কাঁপানো বৃষ্টি নামল। পার্লার থেকে স্বপ্না বুবুর কল, ‘তুই যাওয়ার সময় আমাকে নিয়ে যাস। আজ অনেক বৃষ্টি। একা বাড়ি যেতে ভয় করে। পার্লারের নিচে এসে কল দিস।’
একটা রিকশা নিয়ে এলাম সাজ পার্লারের নিচে। পাঁচতলা ভবনের দোতলায় সাজ পার্লার। উপরের সব ভাড়া বাসা। স্বপ্না বুবুকে কল দিতে গিয়ে দেখি মোবাইলের ব্যালেন্স শেষ। মিনিট দশেক রিকশায় বসে থাকলাম। বৃষ্টির গতি বাড়ছে। স্বপ্না বুবু আসছে না কেন! এই অবেলায় কে এলো বউ সাজতে!
সিঁড়ি মাড়িয়ে দোতলায় উঠলাম। সাজ পার্লারের কলবেল চাপতেই দরজা খুলল এক মেয়ে। কে, চিনি না। মনে হয় রোজি আপা। নম্র কণ্ঠে বললাম, ‘আমি স্বপ্নার ভাই। একটু বুবুকে ডেকে দেবেন?’ কিছুটা অবাক হয়ে তিনি বললেন, ‘কোন স্বপ্না?’ স্বপ্না বুবুর পরিচয় দেয়ার পরও তিনি চিনলেন না। শেষে মোবাইল বের করে ছবি দেখাতেই আমাকে চমকে দিয়ে তিনি জানালেন, ‘এই মেয়ে তো এই ভবনের তিনতলায় এনায়েত উল্লা সাহেবদের বাসায় রোজ সকালে কাজ করতে আসে। আপনি ভুল করে আমাদের কলবেল চেপেছেন। এটা বিউটি পার্লার। যান উপরে যান।’ বলেই তিনি ঠাস করে দরজা বন্ধ করে দিলেন।
আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। স্বপ্না বুবু পার্লারে চাকরির নাম করে অন্যের বাসায় কাজ করে! মানে কাজের মেয়ে!
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিচে নামতেই স্বপ্না বুবুর কল। ওপার থেকে বলল, ‘তুই এসেছিস?’ বললাম, ‘হুঁ।’ আবার বলল, ‘আমি নামছি তাহলে!’
৩.
স্বপ্না বুবু এসেছে। বাইরে অঘোর বৃষ্টি। আমরা ভাইবোন রিকশায় চেপে বসেছি। বৃষ্টি উপেক্ষা করে রিকশা চলছে। আকাশে মেঘের গর্জন। তার চেয়ে বেশি গর্জন আমার বুকে। পরিবারের সুখ শান্তির জন্য পার্লারের নাম করে অন্যের বাসায় কাজ করা স্বপ্না বুবুর পাশে বসে নিজেকে বড় অপরাধী লাগছে। কাল থেকে এখানে আর বুবুকে আসতে দেবো না। আমিই কাজ করব। কোনো হোটেলে নয়তো কোনো দোকানে।
স্বপ্না বুবুকে বললাম, ‘বউ সাজাতে গিয়ে তোর কী কখনো সাজতে ইচ্ছে করে না? যারা পার্লারে কাজ করে, তারা নাকি সব সময়ে সেজেগুজে পরী হয়ে থাকে!’ স্বপ্না বুবু হেসে বলল, ‘নারে, রোজি আপা সাজতে বলে। আমার ওসব ভালো লাগে না।’
ছোটবেলায় কোনো মিথ্যে বললে স্বপ্না বুবু আমাকে শাসন করত। আজ স্বপ্না বুবু কত নিখুঁত করে মিথ্যা বলছে। স্বপ্না বুবু জানে না আজ কত বড় এক সত্য আমি জেনে গেছি। সে সত্য আমাদের মা কখনো জানবে না। আমার ভেজা চোখের পানি মুছে দিচ্ছে বৃষ্টির পানি। বৃষ্টির গতি কেবল বাড়ছে। মনের ভেতরে এক আকাশ বেদনা নিয়ে স্বপ্না বুবুর পাশে বসা আমার বুকটা ভাঙতে লাগল।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী।

 


আরো সংবাদ



premium cement