২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

করোনায় মানুষের পাশে আছেন রাসেল

-

নরসিংদী সদরে থাকেন আবদুল্লাহ আল মামুন রাসেল। নরসিংদী মার্কেন্টাইল ব্যাংকে কর্মরত। স্নাতক করেছেন নরসিংদী সরকারি কলেজ থেকে। করোনার সময়টাজুড়ে অসহায় মানুষকে সহায়তা করে চলছেন। ছুটে চলছেন মানুষের ঘরে ঘরে। মানুষের পাশে দাঁড়ানোর
গল্প বলেছেন রায়হান রাসেদকে

 

লকডাউনে নরসিংদীর চেহারা পাল্টে গেল। মনে হলো, কোথাও কেউ নেই। কোথাও কেউ থাকে না। সেদিন ব্যাংকে যাবার পথে নামতেই বুকটা কেমন করে উঠল। মানুষের শহরে মানুষজন সব হারিয়ে গেল। ইচ্ছে করে, স্টেশনের দিকে গেলাম। নিস্তব্ধ নির্জন স্টেশন। ইহ হুল্লোড় নেই। অথচ এই স্টেশনে মানুষের ভিড়ে মানুষ খুঁজে পেতে কষ্ট হতো। কোনো রকম দিনটা কাটল।
ভেলানগর আমার ব্যাংক অফিস। মোড়ে দেখলাম, অলস পড়ে আছে রিকশা। চালকরা সটান হয়ে রিকশায় শুয়ে আছে। যাত্রী নেই তেমন। একজনের সাথে কথা বলে জানলাম, এভাবে দিন গেলে মালিককে জমার টাকা দেয়া মুশকিল হয়ে পড়বে। বাসায় থাকতে হবে উপস। তাদের ভাবনা আমাকে সারা দিন জড়সড় করে রাখল। অফিসে ভালো গেল না সেদিন। তাদের কথা কেবল ভাবছি। অফিসে বসে সিদ্ধান্ত নিলাম, তাদের পাশে দাঁড়াব। নিজের খরচের টাকা বাঁচিয়ে ৫০টি পরিবারের জন্য এক সপ্তাহের খাবার নিলাম। বিতরণের প্রক্রিয়া নিয়ে চিন্তায় পড়ে গেলাম। সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করতে নরসিংদীর এনডিসি শাহরুখ খানকে ফোন করে ব্যাপারটি বললাম। তিনি ম্যাজিস্ট্রেট ও গাড়ি পাঠালেন। ২৮ মার্চ নরসিংদী শহর ঘুরে ঘুরে রিকশাচালকদের মাঝে ত্রাণ বিতরণ করলাম। আমি বলি ‘ভালোবাসা বিতরণ’। রিকশাচালক সুমনের বাড়ি রাজশাহীর নাটোরে। দুই বছর ধরে নরসিংদীতে গাড়ি চালায়। সুমনের এমন খারাপ সময় আর যায়নি। সারা দিন গাড়ি চালিয়ে জমার টাকা দিয়ে ২০০ টাকাও পকেটে পড়ে না। বাড়িতে বউ আর তিন মেয়ে তার। সপ্তাহে টাকা পাঠান। গত সপ্তাহে ১৩০০ টাকা পাঠিয়েছেন। এই সপ্তাহ ভালো যাচ্ছে না। সন্তানদের নিয়ে ভয়ে আছেন সুমন। সুমনের মতো আরো অনেকেই আছেন। সরেজমিন তাদের অবস্থা আমাকে আহত করল। সবখানে যেন হাহাকার। পরদিন ৫০টি প্যাকেট তৈরি করে লঞ্চঘাট বেড়িবাঁধের রিকশা ও অটোচালকদের কাছে গেলাম।
চিন্তা করলাম, নরসিংদীর বাইরে কোথায় যাওয়া যায়? তখন মাথায় এলো, পূর্ব ব্রাক্ষ্মন্দীর নামাপাড়া বস্তির কথা। ১০০ পরিবারের খাবার নিয়ে বস্তিতে গেলাম। ১০০ পরিবারের বাইরে অনেক পরিবার আছে, যাদের খাদ্য সহায়তা প্রয়োজন। তখন আরো ১০০ পরিবারকে খাদ্য দিলাম। যেন আমার সবকিছু দখল করে আছে অসহায় মানুষের হাহাকার। বস্তির মানুষের তীব্র খাদ্য সঙ্কট এবং হাহাকার দেখে আমি ভীষণ যন্ত্রণায় পড়ে গেলাম। প্রতি মুহূর্তে শুধু মানুষের কথা মাথায় ঘোরে। অসহায়দের কাছে খাবার পৌঁছানোর কথা ভাবছিলাম। তখন বন্ধু রিয়াদ আমাকে সাহায্য করল। আমায় সঙ্গ দিলো। সে সময় আমাদের বাসার নিচতলা খালি। ভাড়াটিয়া নেই। নিচতলায় ত্রাণ কার্যক্রম চলতে থাকল। বাসার নিচতলায় বসে দিনরাত প্যাকেট করতাম। ভেতরে করোনা শঙ্কা ছিল। তবু থেমে থাকেনি। নিজে একা বাঁচার চেয়ে সবাইকে নিয়ে বেঁচে থাকাটা আমার কাছে শ্রেষ্ঠ। মাকে প্রতিদিন ব্যাংকের কথা বলে বের হতাম অথচ ব্যাংক বন্ধ ছিল তখন। মা আমাকে সাবধান থাকতে বলতেন। আমি আমার মায়ের একমাত্র সন্তান।
এক শনিবার রাতে বিছানায় এপাশ ওপাশ করছি। ঘড়িতে তখন দুপুর রাত। ফেসবুকে ঢুঁ মারলাম। একজনের পোস্ট দেখলাম, ‘অনেকে অভাবের কথা বলতেও পারছি না।’ আইডিয়া বের করলাম। ফেসবুকে লিখলাম, ‘ত্রাণের কথা বলতে না পারা মানুষেরা আমাকে নক করুন। আমি গোপনীয়তা বজায় রাখব। কথা দিলাম।’ বেশ নাম জমা পড়ল। অনেকের ঘরে রাতের আঁধারে কিংবা ভোরে আলো ফুটার পূর্বে ত্রাণ দিয়ে আসতাম। একজন ম্যাসেঞ্জারে বলল, ‘আপনাদের কাছে বলে লাভ নেই, পাবলিকের নজর কাড়তে এমন করেন।’ আমি তাকে জানতে চাইলাম। সে আমায় সব বলল। আমি ঠিকানা নিয়ে চলে গেলাম তার বাড়ি। ১০ দিনের খাবার দিয়ে এলাম।
ইটাখোলা থেকে ত্রাণ বিতরণ করে হাইওয়ে রোড ধরে নরসিংদী ফিরছিলাম। আ. কাদির মোল্লার থার্মেক্স’র বরাবর এলে চোখে পড়ে বেদে পল্লী। গাড়ি থামিয়ে সেখানে গেলাম। একটি পাঁচ বছরের শিশু মাটি নিয়ে খেলছে। মুখেও দিচ্ছে। আশপাশের কেউ শিশুকে ধরছে না। জানতে পারি, তার বাবা-মা খাবারের সন্ধানে বের হয়েছে। আরও এগিয়ে কয়েকজনের সাথে কথা বললাম। কাকলী নামের এক মহিলা বলল, ‘শিঙ্গা লাগানোর কাম করি। এখন কাম নাই। পাড়ায় যাইতে পারি না। সংসারে অভাব। পুলাপাইন লইয়া কষ্টে আছি।’ এখানের প্রতিটি পরিবারের গল্প এমন। সেখান থেকে ফিরে খোঁজ করতে লাগলাম, আর কোথায় বেদে পল্লী আছে? একজন জানাল, হাসনাবাদের ডৌকারচরের দিকে বেদে পল্লী আছে। সেখানে গেলাম। তাদের অবস্থাও একই রকম। ওদের জন্য খাবার প্যাক করলাম। হলুদ খামে ভরে দিলাম ২০০ টাকা। তাদের ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে এলাম।
আমার একটা সংগঠন আছে ‘আলোকিত নরসিংদী।’ সেখানে ১৫০ পথশিশু আছে। আমি বলি ‘পথফুল।’ তাদের আমি বিভিন্নভাবে লালন পালন করি। পড়াই। খাবার দিই। ঘুরি। স্কুলে ভর্তি করাই। তাদের মা বাবার সঙ্গে সবার ঘরে খাবার দিয়ে এলাম। ঈদের আগের দিন বিকালে সরকারি কলেজের পথ ধরে বাসাই ফিরছিলাম। পথফুলগুলো আমার পথ আগলে ধরল। একটা ব্যাগ ধরিয়ে দিয়ে বলল, ‘ভাইয়া, সবাই মিল্লা আপনার জন্য কিনছি।’ আমি কিছুক্ষণ থ হয়ে রইলাম। চোখ ভিজে উঠল। মনে করি, আমার জীবনে এ যাবৎ সবচেয়ে ভালো উপহার।
করোনায় মানুষের পাশে দাঁড়ানোটা আমার নেশা পেয়ে বসল। এখন আমার কাছে কোনো টাকা নেই। বোনের জামাই, ছোট বোন, মা-বাবার কাছ থেকে চেয়ে চেয়ে নিয়ে মানুষকে দিচ্ছি। দুই বন্ধু আমাকে তিন হাজার টাকা দিয়েছে। এ ছাড়া কারো টাকা আমি নেইনি। একদিন পকেটে এক হাজার টাকা আছে। প্রমা ভৌমিক নামের এক মেয়ে আমাকে ম্যাসেঞ্জারে জানাল, চিঁড়ামুড়ি খেয়ে বেঁচে আছে। সেই টাকাটা তৎক্ষণাৎ বাজার করে তার বাসায় দিয়ে এলাম। ব্রাক্ষ্মন্দীর সালেহা নামের মহিলা। ব্যাচেলর বাসায় রান্না করত। কলেজ বন্ধে ছাত্ররা বাড়ি চলে গেছে। তার কাজ নেই। আমার কথা শুনে বাসায় এলো। বাসায় তাকে কেউ ঢুকতে দেয় না। খবর পেয়ে নিচে এলাম। তার কথা শুনে, এক মাসের দায়িত্ব নিলাম। বলল, সে আমার জন্য সবসময় দোয়া করে।
আরশিনগরের রিপন। আমার বন্ধু। তারা বস্তির মতো গাদাগাদি করে থাকে সেখানে। প্রায় ১০০ পরিবার। সে বলল, তুই তো অসহায়কে সাহায্য করিস। আমাদের সাহায্য প্রয়োজন। তখন আমার পকেটে টাকা নেই। একজন ক্ষুদে ব্যাংকারের যা অবস্থা আরকি। ১০ দিন পর হাতে কিছু টাকা এলো। সেখানের ১০০ পরিবারকে ত্রাণ দিলাম। ঈদে সেমাই দিলাম।
আমি সবসময় মানুষের জন্য কাজ করতে চাই। মানুষের পাশে দাঁড়াতে চাই। আমার মা আমার প্রেরণা। ছেলেবেলায় দেখতাম, মা অনেক মানুষকে টাকা, চাল, ডাল, তরকারি দিয়ে মহিলাদের সাহায্য করছেন। মাকে দেখে দেখে শিখেছি। সারাটা জীবন মানুষের পাশে থেকে মানুষকে সাহায্য করতে চাই।

 


আরো সংবাদ



premium cement