২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বিস্কুট

চারাগল্প
-


হাসপাতালের জীর্ণ বেডে শুয়ে মা যখন পর্যাপ্ত চিকিৎসার অভাবে, বলা যায় অনেকটা ডাক্তারদের অবহেলায় মারা যায়, তখন সবুজের বয়স কেবল সাত বছর। এক পড়ন্ত বিকেলে মা হাসপাতালে মারা গেছে, এমন সংবাদ শুনেও সবুজকে বিচলিত হতে দেখেনি কেউ। অথচ এই মায়ের সাথে সবুজের ছিল সবচেয়ে বেশি সখ্য।
সবুজের মনে আছে, সন্ধ্যার পর অ্যাম্বুলেন্সে করে মায়ের লাশ আনার পর দশ গেরামের মানুষ ছুটে এসেছে। দাদাজানের বাড়ি কাঁপানো কান্নায় সবাই শোকার্ত হয়ে উঠল। মধ্যরাতে মায়ের লাশটা যখন সবাই পুকুর পাড়ের কবর পাড়ায় নিয়ে গেল খাটিয়ায় করে, সবুজ তখন অঘোরে ঘুমাচ্ছে। ঘুম ভাঙল একেবারে সাত সকালে। তার কিশোর দুটি চোখ দেখতে পেল এই গাঁয়ের এতিমখানার কয়েকটি ছেলে উঠানে পাটি বিছিয়ে কুরআন পড়ছে। তাদের পাশে এসে দাঁড়ায় সবুজ। আজ থেকে এ ছেলেগুলোর মতো সেও এতিম। মা যে তার কাল মরে গেছে।
স্ত্রী-বিয়োগের চার মাস পর ইসহাক আলী দ্বিতীয় বিয়ে করেন। মায়ের বদলে নতুন মা এসেছে সবুজের। নুরুন্নাহার সবুজের সৎ মা হয়ে এই সংসারে এলো। নুরুন্নাহারের আগেও একটি বিয়ে হয়েছে। বজ্রপাতে আগের স্বামী মারা গেছে।
সময়ের সাথে সাথে সৎ মায়ের অশোভনীয় আচরণের শিকার হতে থাকে সবুজ। সতীপুত্রকে তিনবেলা পেটপুরে খাবার না দেয়ার বদ রেকর্ড গড়ে ফেলে নুরুন্নাহার। সবুজও যে একেবারে নির্দোষ, তাও নয়। পড়ালেখায় অমনোযোগী, সারা দিন টই টই করে মাঠে ঘুরে বেড়ানো, পাতিল থেকে দুধের সর বা মাছের বড় টুকরাটি চুরি করে পেটে চালান দেয়া, ভোরে হাঁসের খোয়াড় থেকে ডিমগুলো সরিয়ে ফেলা, বোয়াম থেকে আচার গোপনে খেয়ে ফেলা কিংবা মোটকায় তুলে রাখা নুরুন্নাহারের সুপারিগুলো সরিয়ে নিয়ে বিক্রি করে ফেলাÑ এসব কারণে সবুজ সৎ মায়ের কাছে দিন দিন নিন্দার পাত্র হয়ে ওঠে। ‘এই ছেলে বড় হয়ে আস্ত একটা চোর হবে’Ñ নুরুন্নাহারের এসব অপবাদ এখন আর সবুজের কাছে অসহ্য লাগে না, বরং সৎ মায়ের যেকোনো অপবাদ তার এখন সয়ে গেছে।
সাত বছরের একটি কিশোর ছেলে অবুঝই বটে, এই অবুঝ ছেলের সাথে যে নুরুন্নাহারের বনিবনা হয় না, ইসহাক আলী তার কিছুই জানেন না। জানবেনই বা কি করে, ভোর হলে যে তিনি চলে যান ব্যবসার কাজে। ফিরেন মাঝরাতে। ছেলেটা কেমন আছে না আছে, তা জানাও দরকার মনে করেন না তিনি।
বিদ্যা পাঠে অমনোযোগী বলে কোনো পরীক্ষায় পাস করে না সবুজ। শিক্ষার্জনে ছেলের অবনতি দেখে ইসহাক আলী ছেলের লেখা পড়া বন্ধ করে দেন। এতে মনে মনে মহা খুশি সবুজ।
কোনো কোনো দিন বিকেল বেলায় বাবাকে বাসায় ফিরতে দেখা যায়। বাবার হাতে থাকে নানান ফলমূল, নয়তো খাবারের কি সব প্যাকেট। এসব খাবার কই যায়! মা তো সবুজকে বাবার আনা ওসব খাবারের চিহ্নও দেখায় না। ঘরের পেছনে পড়ে থাকতে দেখা যায় কমলার খোসা আর বিস্কুটের জীর্ণ প্যাকেট। সবুজ কাতর চোখে সেসব দেখে।
নুরুন্নাহার যখন পুকুর ঘাটে থালা-বাসন ধোয়ায় ব্যস্ত, সবুজ তখন চুরি করে মায়ের রুমে যায়। বিশাল এক প্লাস্টিকের কন্টেইনার খোলে সবুজ। সেখানে আপেল, পাকা কলা আর গোল গোল বিস্কুট দেখে তার চোখ চিক চিক করে ওঠে। ঝড়ের বেগে কয়েকটা পাকা কলা মুখে ভরে দিয়ে স্থান ত্যাগ করে সবুজ। নয়তো মায়ের চোখে ধরা পড়ে যাবে। বাবা ঘরে এতগুলো খাবার আনে, অথচ সবুজকে কিছুই দেয়া হয় না।
২.
সেদিন দুপুর বেলা। নুরুন্নাহার ঘরে নেই। এই সুযোগে সবুজ মায়ের ঘরে ঢুকতেই প্রথমে চোখ পড়ে খাটের পায়ার কাছে একটা বিস্কুটের খোলা প্যাকেটে। সেখানে চারটি বিস্কুট। জিভে পানি আসার আগেই সবুজ বিস্কুটগুলো খেয়ে চুপি চুপি বেরিয়ে এলো।
কিছুক্ষণ পর পেটব্যথা বাড়ে সবুজের। ব্যথার তোড়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। বমির ভাব হয়। কিন্তু বমি না এসে মুখ থেকে লালা ঝরতে থাকে। নুরুন্নাহার সবুজের এই অবস্থা দেখে চিৎকার দেয়। ততক্ষণে নিথর হয়ে সবুজের মুখমণ্ডল কালো বর্ণের হয়ে যায়।
ডাক্তারের কাছে আনা হয় সবুজকে। ডাক্তার জানালেন ‘ছেলেটা আরো আগে মারা গেছে’।
রাতেই দাফন করা হয় সবুজকে। ছেলেটা এভাবে চুপচাপ মারা গেল কেন, কেউ জানতে পারল না। ইসহাক আলী ছেলের শোকে পাথর হয়ে গেলেন।
ইঁদুরের উৎপাতে নুরুন্নাহার বিস্কুটে বিষ মেখে খাটের তলায় রেখেছে ইঁদুরগুলো তা খেয়ে মারা যাবে বলে। কিন্তু সে বিষমাখা বিস্কুট খেয়ে যে সবুজ মারা যাবে, এ ঘটনা স্বয়ং নুরুন্নাহারও জানতে পারল না। সবুজের মৃত্যুটা সবার কাছে অজানা রহস্যই রয়ে গেল।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী

 


আরো সংবাদ



premium cement