২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

করোনায় মানুষের পাশে আলোর পথযাত্রী

আলোর পথযাত্রীর সদস্যরা মানুষকে সচেতনতার পাশাপাশি ত্রাণ বিতরণ করছেন -


করোনা আতঙ্কে গোটা বিশ্ব আজ প্রকম্পিত। আকাশে-বাতাসে আজ মৃত্যুর মিছিল। সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তায় পার হচ্ছে প্রতিটি মানুষের জীবন। মানুষের মুখ আজ বিষণœতায় ছেয়ে গেছে। করোনা এমন একটা মারাত্মক ভাইরাস যার ভয়াবহতা আজ এই পৃথীবির কারো অজানা নয়। আমরা দেখেছি চীনে ভয়াবহতা। মানুষ যেখানে পিঁপিলিকার মতো মরেছে রাস্তাঘাটে। ইতালির মতো জায়গায় লাশে লাশে ছেয়ে গেছে। আমেরিকা যেন আজ লাশের গুদামে পরিণত হয়েছে। সারা বিশ্বের মৃতের সংখ্যা বাড়ছে স্টপওয়াচের মতো। সেকেন্ডে সেকেন্ড মরছে মানুষ। করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত লাশকে পুড়িয়ে দেয়া থেকে শুরু করে পানিতে ভাসিয়ে দেয়া এমনকি ক্রেনের মাধ্যমেও মাটিচাপা দিতে দেখেছি আমরা। এ এমন এক ভাইরাস যা একজনের থেকে ছড়িয়ে পড়ে হাজারো জনের মধ্যে। এমন পরিস্থিতি বিশ্বের বেশির ভাগ দেশ আজ লকডাউনে। বাসা থেকে বের হওয়া একদম নিষিদ্ধ। বাংলাদেশেও তার ব্যতিক্রম নয়। মাইকিং, লিফলেট, প্রশাসনিক তদারকি করে মানুষকে ঢোকানো হচ্ছে ঘরে। করোনা-আক্রান্ত রোগীকে নিজের পরিবারের মানুষরা পর্যন্ত ত্যাগ করে চলে যেতে দেখেছি। মানুষ আজ নিজের জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত। সেখানে স্বেচ্ছাসেবক সেজে রাস্তায় নেমে মানুষকে সচেতন করা, বাড়ি বাড়ি মানুষদের করোনার ভয়াবহতা ও করণীয় কী সে বিষয়ে জানান দেয়ার চিন্তাটা সত্যিই যে কতটা সাহস ও মানবিকতার সাক্ষী সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। এমনই এক সৎসাহসী ও মানবিক স্বেচ্ছাসেবক সংগঠন ‘আলোর পথযাত্রী’। ২০১৭ সালে ৪২ জন সদস্য নিয়ে এলাকা থেকে অজ্ঞতার অন্ধকার দূর করে আলোর পথে মানুষকে ডাকা ও আলোর পথ দেখানোর দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এ সংগঠন গঠন করা হয়। সবাই ছাত্র। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র জান্নাতুল ফেরদাউস ও আলাফাত হোসেন রোজ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শওকত ইসলামসহ দেশের বেশ কয়েকটি স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করে এই সংগঠনের সদস্যরা। প্রাথমিকভাবে টিউশনি করে টাকা জমিয়ে সেই টাকা দিয়ে এলাকার স্কুল-কলেজপড়–য়া দরিদ্র ছেলেমেয়েদের পাশে দাঁড়াত। কখনো বই কিনে দিয়ে, কখনো বা স্কুল ড্রেস বানিয়ে দিয়ে। এরপর ঈদ-পূজায় খুঁজে খুঁজে বের করে নিঃস্ব, সহায়-সম্বলহীনদের বাজার করে দেয়া হতো। এলাকা থেকে কোনো ছেলে এসএসসি কিংবা ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর কোথাও ভর্তি হতে সমস্যা হলে তখন তার পাশে এসে দাঁড়াত এই সংগঠন। এর বেশ কয়েকটি নজির রয়েছে। করোনাভাইরাসের এই দুর্দিনেও এই আলোর পথযাত্রী সংগঠন নিয়েছে নানান সব সৃজনশীল পদক্ষেপ। মফস্বলে যে পদক্ষেপগুলোর বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, ভাবতেও পারেন না অনেকে। দেশে যখন করোনার প্রভাব পড়ল তখন এই ‘আলোর পথযাত্রী’ ছুটে এলো মানুষের পাশে। এই শিক্ষিতসমাজ বুজতে পেরেছিল, তাদের এলাকার মানুষ কতটা অসচেতন। শিক্ষিত এই সমাজ লিফলেট হাতে নিয়ে বের হলো এলাকায়। হাট-বাজার, মাঠ-ঘাট ডিঙিয়ে মানুষকে নানাভাবে সচেতন করতে শুরু করল। নিজেদের ব্যক্তিগত তহবিল থেকে সাবান, হ্যান্ডওয়াশ বিলি করতে শুরু করল চার-পাঁচটা গ্রামে। বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করে দিলো এ ‘আলোর পথযাত্রী’র যাত্রীরা। প্রায় তিন শতাধিক পরিবারের মধ্যে সাবান বিতরণ করে এই সংগঠন। এরপর করোনা যখন ভয়াবহ রূপ নিতে শুরু করল তখন বিতরণ করল মাস্ক। এরপর মানুষ যখন ঘরবন্দী, দিন আনা দিন খাওয়া মানুষদের যখন ঘরে থাকতে বলা হলো; মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই এই নি¤œবিত্তের মানুষের জীবন হতে শুরু করল দুর্বিষহ। অনাহারে কাটতে লাগল অনেকেরই জীবন। যেটা এখনো অব্যাহত রয়েছে। তখন ‘আলোর পথযাত্রী’ আর বসে থাকতে পারল না। অর্থ নয়, সাহস ও মানুষ হিসেবে নিজেদের দায়িত্ববোধকে পুঁজি করেই উদ্যোগ নিলো অসহায় এই মানুষগুলো ঘরে খাবার পৌঁছে দেয়ার। এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়ে এর সাথে যুক্ত হলেন এলাকার আরো কিছু সিনিয়র ব্যক্তি। যারা করপোরেট লাইফে ভালো পদে চাকরি করেন। তাদের সহযোগিতায় ও সংগঠনের সদস্যদের অক্লান্ত পরিশ্রমের বিনিময়ে প্রায় শতাধিক পরিবারের মধ্যে ১০ কেজি করে চাল, এক কেজি ডাল, এক কেজি চিনি, এক কেজি তেল, এক কেজি আলু, এক কেজি লবণের প্যাকেজ পৌঁছানো হয়। ‘আলোর পথযাত্রী’র সভাপতি শওকত ইসলাম বলেন, এই উপহার দিতে গিয়ে অনেক বাড়িতে আমরা দেখেছি করুণ অবস্থা। সহ-সভাপতি জান্নাতুল ফেরদাউস বলতে গিয়ে আবেগঘন পরিস্থিতির সৃষ্টি করে বলেন, ‘বেশির ভাগ পরিবারেরই এমন পরিস্থিতি যে, বলে বুঝানো সম্ভব নয়। যা দেখে আমার মনে হয়েছে, করোনা-আক্রান্ত হয়ে নয়, মানুষগুলো না খেয়েই মারা যেত। এমন আরো অনেক পরিবার রয়েছে যাদের পাশে আমরা যেতে পারিনি।’
এ রকম সংগঠনগুলো দেখলে মনে হয় ‘মানুষ মানুষের জন্য সেবাই পরম ধর্ম, ভোগে নয়, ত্যাগেই প্রকৃত সুখ’ কথাগুলো সত্যিই যথার্থ। ভালো থাকুন ‘আলোর পথযাত্রী’র সব যাত্রী।

 


আরো সংবাদ



premium cement