২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

করোনা বিজয়ের গল্পগাথা

-

বিশ্বব্যাপী এক আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস । এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ইতোমধ্যে প্রাণ হারিয়েছেন লাখ লাখ মানুষ। তবে তার চেয়েও বেশি মানুষ সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরেছেন। তাই শুধু হতাশা নয়। প্রয়োজন সচেতনতা আর স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা। আতঙ্ক, সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, চিকিৎসা, পরিবার-পরিজনের হাহাকারÑ সব বাধা উত্তীর্ণ হয়ে মহামারী করোনাকে জয় করা অসংখ্য মানুষের মধ্যে তেমনি একজন মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আইরিন আক্তার, অপরজন ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক খ্যাতিমান সাংবাদিক এমদাদুল হক খান। তাদের জবানিতেই শুনব করোনা বিজয়ের নানা দিক, নানা তিক্ত অভিজ্ঞতা কিংবা ভালোবাসার নয়া মেরুকরণের গল্পগাথা।
আইরিন আক্তার
ঘিওর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও)
‘আমার সাথে আমার আড়াই বছরের শিশুটি যেদিন কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছিল, সেদিন কিছুটা হলেও শঙ্কিত হয়ে পড়েছিলাম। মা-মেয়ের কোভিড-১৯ এর পজেটিভ ফলাফল দেখে জেলা প্রশাসককে প্রথম ফোন করি। তিনি সাহস দিলেন, শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিলেন, আইসোলেশনে থাকতে বললেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার পরামর্শ দিলেন। ফোন রেখে শুধু ভাবছিলাম, এইটুকু শিশুকে ঘরের মধ্যে ১৪ দিন কিভাবে আটকে রাখব! মানিকগঞ্জ-১ আসনের সংসদ সদস্যকে তার পরের ফোনটা করি এবং কোভিড-১৯ টেস্ট করানোর অনুরোধ করি। কারণ পজেটিভ রেজাল্ট আসার কিছুক্ষণ আগেও সংসদ সদস্যের সাথে একটি প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করি। আগামী ১৪ দিন ত্রাণ বিতরণ, সরকারি বিভিন্ন নির্দেশনা বাস্তবায়ন, দাফতরিক কার্যক্রম, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি তদারকি বাসায় বসে কিভাবে করব, এরকম অদ্ভুত চিন্তা একের পর এক মাথায় আসতে থাকে।
অল্প সময়ের মধ্যে এ খবর উপজেলার গণ্ডি পেরিয়ে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে। পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, সহকর্মী, বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশনের অনেক সিনিয়র স্যার, পরিচিত পরিমণ্ডলের অনেকেই ফোন করেন, কিন্তু ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক যার বেশির ভাগ ফোনই রিসিভ করিনি। আমার শাশুড়ি মা প্রতিবেশীর কাছ থেকে জানতে পারেন, তার ছেলের বউ করোনায় আক্রান্ত। আমার মা নিউজ দেখে জানতে পারেন। দু’জনই এ খবর জেনে খুব ভেঙে পড়েন। নিজে যতটা না করোনা পজেটিভ হয়ে বিচলিত হয়েছি, তার চেয়ে বেশি উদ্বিগ্ন আর দুশ্চিন্তায় ছিলেন আমার পরিবারের সদস্যরা। স্বাস্থ্যঝুঁকি উপেক্ষা করে আমার আর আমার সন্তানের বিচ্ছিন্ন পৃথিবীতে আমার স্বামী স্বেচ্ছায় আমাদের সঙ্গী হলেন। ‘বাঁচলে একসাথে বাঁচব, মরলে একসাথে মরব’Ñ তার এ কথায় আমি তাকে আরেকবার নতুন করে চিনি। এই কয়টি দিনে সে যেভাবে আমাদের সেবা শুশ্রƒষা করেছে, তা আমার কাছে একেবারে অপ্রত্যাশিত ছিল। আমাদের অনেক শ্রদ্ধাভাজন সিনিয়র স্যার সামাজিক দূরত্ব এবং স্বাস্থ্যবিধি মেনে তাকে আমাদের (করোনা পজেটিভ) পাশে থাকার পরামর্শ দেন।
যেদিন আমার করোনা পজেটিভ রেজাল্ট এলো, সেদিন রাতেই আমার সব স্টাফের শিবালয় উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় শিবালয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কোভিড-১৯ টেস্টের জন্য স্যাম্পল দেয়া হয়। এর পরদিন আমার এক স্টাফ অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে অফিসে আসেনি; আমার বাসায় যে মেয়েটি আমার সন্তানকে দেখাশোনা করত, তাকে তার শ্বশুরবাড়ির লোক আটকে রেখেছিল; আরেকজন যিনি রান্না করে আমাদের এই দুঃসময়ে সব বাধা উপেক্ষা করে আমাদের পাশে ছিলেন, তার বর তাকে একদিন আচ্ছা করে বকা দিচ্ছিল যা দোতলা থেকে আমি স্বচক্ষে দেখতে পাই। ত্রাণের জন্য সকাল থেকে বাংলোর গেটে ভিড় করা সেই জনগোষ্ঠীকে আর দেখা গেল না। উপজেলা পরিষদের কোনো পরিবারকেও বাইরে দেখা গেল না। চার দিকে সুনসান নীরবতা।। যেখানে জীবন-মরণের প্রশ্ন, সেখানে মানুষের এই আচরণগত পরিবর্তনটা বেশ স্বাভাবিক হিসেবেই ধরে নিলাম। মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া যারা করোনা ভয়ে ভীতু ছিল, তাদের প্রত্যেকের কোভিড-১৯ এর ফলাফল নেগেটিভ।
আইসোলেশনের ১২তম দিনে দ্বিতীয়বারের মতো স্যাম্পল দিলাম, ১৪তম দিনে রেজাল্ট নেগেটিভ এলো। মুক্ত পৃথিবীতে পদার্পণের লক্ষ্যে গাড়ি নিয়ে উপজেলার সার্বিক পরিস্থিতি দেখতে বের হলাম। রাত তখন ৮টা। সবকিছু স্বাভাবিক নিয়মে চলছে। মহান সৃষ্টিকর্তার অশেষ কৃপায় এ যাত্রায় আমরা বেঁচে ফিরেছি।’
এমদাদুল হক খান
সাংবাদিক
‘করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলাম। বড় মেয়ে ও স্ত্রীরও পজেটিভ রিপোর্ট এলো। শুধু ছোট মেয়ের নেগেটিভ আসে। শ্যালকের মাধ্যমে তাকে বাসায় পাঠাই। কিন্তু তাদের প্রথমে বাসায় ঢুকতে দেননি প্রতিবেশীরা। তারা বলেন, আপনাদের মাধ্যমে আমাদেরও সংক্রমিত করবেন। চার মাস পর বাসায় আসবেন। পরে ফ্ল্যাট মালিক সমিতির একজন এগিয়ে আসেন, যিনি বাড়ি নির্মাণে জমি দিয়েছেন। বললেন, ওরা নিজেদের বাসায় থাকবে। এ বিপদের সময় তারা কোথায় যাবে? তিনি নিজে এসে আমার ছোট মেয়েসহ ওই আত্মীয়কে বাসায় তুলে দেন।’ করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর তিক্ত অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিলেন সাংবাদিক এমদাদুল হক খান। ইতোমধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল থেকে বাসায় ফিরেছেন সাংবাদিকতার পাশাপাশি এ নাট্যনির্মাতা। স্ত্রী ও এক মেয়েসহ তিনি উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। বাসায় ফিরে পরিবারের সদস্যদের পৃথকভাবে আরো ১৪ দিন হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে হয়েছে।
সেই আতঙ্কিত সময়ের বর্ণনা দিয়ে এমদাদুল হক খান বলেন, ‘প্রথম যখন করোনা পজেটিভ ধরা পড়ল, খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। আমার এমনিতেই ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ আছে। ফলে ভয়টা ছিল বেশি। তারপর আবার স্ত্রী ও দুই মেয়ের জন্য খুব কষ্ট হচ্ছিল। আমি না থাকলে তাদের কী হবে? তারাও এই ভাইরাসে সংক্রমিত হলো কি না? এসব চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেত। কিন্তু আল্লাহ সহায় হয়েছেন। আমি, আমার স্ত্রী ও এক মেয়ে করোনাকে পরাজিত করে বাসায় ফিরেছি। আরেক মেয়ের করোনা নেগেটিভ এসেছিল আগেই। হাসপাতালের দিনগুলো খুব শঙ্কার মধ্যে কাটিয়েছি। প্রতিদিনই খবরে মৃত্যু সংবাদ দেখছিলাম। বাসায় এসে মনে হলো যেন সত্যিই মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এলাম।’
বাংলাদেশের খবর পত্রিকার ওই সাংবাদিক বলেন, ‘করোনা পজেটিভ হওয়ার খবরে প্রথমে ভেঙে পড়ি। চোখের সামনে যেন সব ঝাপসা হয়ে আসছিল। কিন্তু আমার সাংবাদিক সহকর্মী, ডিরেক্টর গিল্ডের সহকর্মীরা ফোন করে সাহস জোগান। তাদের সহযোগিতায় দুই সন্তান ও স্ত্রীকে নিয়ে আমি ওই দিন রাতেই উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালে ভর্তি হই। এরপর আমার স্ত্রী ও দুই মেয়ের করোনা পরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে স্ত্রী ও বড় মেয়ের পজেটিভ রিপোর্ট আসায় তিনজনই হাসপাতালে থেকে চিকিৎসা নেয়া শুরু করি। বেসরকারি হাসপাতালে বেশ ভালো চিকিৎসাসেবা পেয়েছি। প্রতিদিনই চিকিৎসক ও নার্সরা আসতেন। এ ছাড়া প্রয়োজন হলে মোবাইল ফোনেও কথা বলতেন। জ¦র, সর্দি-কাশি, গলা ব্যথার পাশাপাশি প্রচণ্ড শরীর ব্যথা ছিল আমার। চিকিৎসক প্যারাসিটামল ও অ্যান্টিবায়োটিকসহ বিভিন্ন ওষুধ দিয়েছিলেন।’
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাবেক সাংস্কৃতিক সম্পাদক এমদাদ বলেন, ‘আমার সবসময় মনে হয়েছে, যেভাবেই হোক বাঁচতে হবে। এ জন্য আমি চিকিৎসকের পরামর্শ যথাযথভাবে পালন করেছি।
আক্রান্তদের উদ্দেশে এমদাদ বলেন, ‘করোনা পজেটিভ হলেই ভেঙে পড়বেন না। মনোবল রাখুন। অ্যান্টিবডি তৈরির জন্য ফলমূল ও ডিম-দুধ খান। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। তাহলেই করোনাকে জয় করতে পারবেন।’


আরো সংবাদ



premium cement