২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাড়ি চারাগল্প

-

এই সংসারের মায়া ত্যাগ করে রকি যখন আমাদের ছেড়ে চলে গেল, বাবা মানসিকভাবে ভেঙে পড়লেন। মানসিক আঘাত অবশ্য আমি আর মা-ও পেয়েছি, তবে বাবার তুলনায় কম। কোনো কোনো মাঝরাতে বাবা রকির স্মৃতিচারণ করে কাঁদতেন। বাবার চাপা অভিযোগÑ রকিকে তিনি পিতৃ¯েœহ থেকে কখনো বঞ্চিত করেননি, তবু রকি এভাবে সব ছেড়ে চলে যাবে, আমরা কেউ ধারণা করিনি। ঘটনার দিন সকাল ৮টায় রকির ঘরে একখানা চিঠি আবিষ্কার করি। চিঠিতে রকি লিখেছেÑ ‘বাবা, আমাকে ক্ষমা করবেন। ছোটবেলা থেকে বাবার মমতায় আমাকে বড় করেছেন, পড়ালেখা শিখিয়েছেন। সবার মুখে মুখে যখন জানতে পারলাম আমি আপনাদের সন্তান নই, এমনকি আপনাদের সাথে আমার রক্তের সম্পর্কও নেই, তখন থেকে আমার যন্ত্রণা। সেদিন সেই ছোট্ট অনাথ শিশুকে পথের ধুলা থেকে তুলে এনে সন্তানের মতো লালন পালন করে একটি মহৎ কাজ করেছেন বটে, কিন্তু আপনারা তো আমার কেউ নন। আমার কোনো ঠিকানা নেই। আপনারা আমাকে করুণা করে আশ্রয় দিয়েছেন, এই সত্য আমাকে কুরে কুরে খায়। তাই ভাবলাম আর এখানে থাকব না। আমি ঠিকানাহীন মানুষ, আজ ভোরের ট্রেনে অজানা গন্তব্যে চলে গেলাম। আমার ওপর কোনো রাগ রাখবেন না।’
রকিকে কখনো আমরা করুণার চোখে দেখিনি, অভাবে রাখিনি, তবু সে আমাদের ভালোবাসার জায়গাটাকে এক ধরনের অপমান করে চলে গেল। এ ঘটনার শুরুতে মা প্রচণ্ড কষ্ট পেলেও পরে তিনি ক্রমেই স্বাভাবিক হতে লাগলেন। বাবা যখন রকির স্মৃতিকাতরতায় ভুগতেন, মা বলতেন ‘ওর জন্য চিন্তা করবে কেন? ও তো প্রমাণ করে দিলো পর কখনো আপন হয় না।’
সত্যি রকি আমাদের কখনো আপন হয়নি। আমাদের অভাবের সংসারে সেও তিনবেলা খেত। স্কুলে যেত কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে। রকির স্মৃতির সাথে আমার আর মায়ের দূরত্ব বাড়ে। ওর ব্যবহৃত জিনিসগুলো ক্রমেই হারাতে থাকে। হারাতে হারাতে একদিন লক্ষ করি, রকির কোনো চিহ্নই আর আমাদের কাছে নেই। মাঝে মাঝে মনে হয় রকি আসলে অনাথ বলে কষ্ট পেয়ে নয়, আমাদের অভাব দেখে সব ছেড়ে চলে গেছে।
২.
অভাব। এখন আর আমাদের অভাব নেই। আমি এখন ব্যাংকের ম্যানেজার। মোটা মাইনে। লাখ টাকার বান্ডিলের তলে চাপা পড়েছে অভাব নামের বিষকাঁটা। এই ভাঙা ঘরে আর নয়, ঠিক করেছি আমি এই নিভৃত গ্রাম ছেড়ে দূরে কোথাও সুন্দর জায়গায় একখণ্ড জমিন কিনব। সে জমিতে গড়ে উঠবে আমাদের ডুপ্লেক্স বাড়ি। বাড়ির নাম হবে বাবার নামে। জলিল ভিলা।
৩.
কাল মাঝরাতে বাড়ি নির্মাণ নিয়ে বাবার সাথে আলাপ করতে বসেছি। বাবা জানালার পাশে বসে বাইরের জোছনা দেখছেন আর আমার বাড়ি করার পরিকল্পনা শুনছিলেন। কয়টা রুম হবে, পেইন্টিং কোন কালার, কয়টা বাথরুম, সিঁড়ি কোন দিকে হবেÑ সব কিছু বলে গেলাম আর বাবা চুপচাপ শুনে গেলেন। এই কুঁড়েঘর ছেড়ে আমরা ডুপ্লেক্স বাড়িতে উঠব ভেবে বাবা হয়তো আনন্দে নির্বাক ছিলেন। হঠাৎ বাবা আমাকে অদ্ভুত এক প্রস্তাব দিলেন।
Ñকোনো রেলস্টেশনের পাশে বাড়িটা কর খোকা।
Ñবাবা তোমার মাথা খারাপ? রেলস্টেশনের পাশে কেউ বাড়ি করে?
Ñকরে খোকা। আমাদের বাড়ি হবে রেলস্টেশনের পাশে।
Ñঠিক আছে। তুমি যখন বলেছ, তাই হবে।
Ñবাড়ির ছাদটা যেন সুন্দর হয়।
Ñআচ্ছা।
Ñআমি রোজ রাতে সে বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে থাকব ভোর পর্যন্ত। তাকিয়ে থাকব দূরের লম্বা রেললাইনের দিকে। তারপর ভোরে যে ট্রেনটা আসবে, সে ট্রেন থেকে যে যাত্রীগুলো নামবে, তাদের মাঝে রকিকে খুঁজব। দেখিস খোকা, কোনো এক ভোরে রকি আমাদের কাছে আসবে। যেভাবে সে এখান থেকে এক ভোরে চলে গেছে।
তরল গলায় বাবা এসব বলছেন আর তার চোখের পানিতে গাল ভিজে যাচ্ছে। স্তব্ধ হয়ে গেলাম। বাবার ভেতরে এক গোপন প্রতীক্ষা দেখতে পেলাম। রকির জন্য বাবা এভাবে রোজ গোপনে প্রতীক্ষা করে থাকেন? আচ্ছা রকির কি আমাদের কথা মনে পড়ে? কোনো এক ভোরের ট্রেনে সে কি আমাদের দেখতে আসবে!
বাবা কাঁপা স্বরে বললেন ‘সে বাড়ির নাম হবে রকি ভিলা’। আমি ছোট্ট করে বললাম ‘আচ্ছা’।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী


আরো সংবাদ



premium cement