২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫
`
পাঠক সংখ্যা

৭১-এর দিনগুলো

-

১৯৭১ সাল। আমি তখন অজ পাড়াগাঁয়ের স্কুলের তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র। আমরা পাকিস্তানের অধীনে ছিলাম, নিজেদের স্বাধীনতার জন্য দেশের মানুষ মুক্তি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে এসবের অর্থ তখন বুঝতাম না, বোঝার মতো জ্ঞান-বুদ্ধি তখনো হয়নি। শুধু শুনতাম-দেখতাম-ভয়ে দৌড়াতাম। স্বাভাবিক জীবন-যাপন চলছে হঠাৎ করেই খবর আসে অমুক গ্রামে মিলিটারি আসছে, আমাদের গ্রামের দিকেও আসছে, এক মুহূর্ত দেরি না করে গ্রামের ছোট-বড় নারী-পুরুষ সবাই দৌড়ে চলে যেতাম আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদী পার হয়ে ধান-পাট-গমের ক্ষেতের মধ্যে। ক্ষেতের মধ্যে মাথা নিচু করে কোনো ‘টুঁ’ শব্দ না করে চুপ করে সবাই বসে থাকতাম। অন্তত দেড়-দুই ঘণ্টা পর কেউ এসে সংবাদ দিলে তারপর চলে আসতাম বাড়িতে। চব্বিশ ঘণ্টাই এমন আতঙ্কের মধ্যে কাটাতে হয়েছে পুরো নয়টি মাস।
কোনো কোনো সময় এমনও হতো দুপুরে গ্রামের লোকজন গোসল সেরে সবে মাত্র খেতে বসেছে, এ অবস্থায় মিলিটারি আসার সংবাদ পাওয়ামাত্র ভাতের থালা রেখে ছুটে পালিয়ে যাওয়া হতো ধান-পাটের ক্ষেতে। আবার কোনো সময় হয়তো ভাত-তরকারি রান্না হচ্ছে এ অবস্থায় সংবাদ পাওয়া মাত্র চুলার মধ্যে পানি দিয়ে আগুন নিভিয়ে চুলার ওপর পাতিল রেখে ছুটে পালিয়ে যেতাম নদীর ওপারে। আল্লাহর রহমতে এই নয়টি মাসের মধ্যে মিলিটারিরা আশপাশের গ্রামগুলো জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে দিলেও চারিদিকে নদীবেষ্টিত আমাদের এই অজপাড়াগাঁয়ে ওদের পা পড়েনি।
আমার বাপ-দাদারা ছিলেন বড় গৃহস্থ। ছোটবেলা থেকে দেখেছি আমাদের পালে প্রায় সময়ই ১০-১২টি গরু থাকত। সেজন্য আমার বাবা প্রতি বছর সিরিয়ালে বয়স বেশি গরুটি কোরবানি দিতেন সাথে একটি খাসিও। কোরবানি হয়ে গেলে সামনের বছরের জন্য হাট থেকে পুনরায় একটি খাসি কিনে আনতেন। সেটি এক বছর আমি দেখাশোনা, পালা-পুষা করতাম। শুনেছিলাম রাজাকার এবং মিলিটারিদের প্রধান টার্গেট খাসি। আমার মেজো দাদাও আমাদের মতোই একটা করে খাসি কোরবানি দিতেন হাট থেকে কিনে আনতেন আর দাদার নাতি অর্থাৎ আমার ফুফাত ভাই সেটি পালা-পুষা করত। মিলিটারি আসার খবর যখন পেতাম তখন আমরা দু’জন খাসি নিয়ে দ্রুত পাটের ক্ষেতে চলে যেতাম। খাসি যাতে ভ্যাঁ-ভ্যাঁ না করে সেজন্যে পাটের গাছ হেলে ধরে পাটের পাতা খাওয়াতাম মাঝে-মধ্যে খাসির গলা চিপে ধরে থাকতাম। ১-২ ঘণ্টা এভাবে আতঙ্কের মধ্যে কাটিয়ে বাড়িতে চলে আসতাম। খাসি নিয়ে এই ভোগান্তিতে পুরো নয়টি মাস পড়তে হয়েছে।
ছোটবেলায় গরমের সময় শখ করে মাঝে মধ্যে বাইরের বারান্দায় ঘুমাতাম। একদিন রাতে আমরা দু’জন আমার এক চাচার বারান্দায় শুয়ে আছি। অনেক রাতে হঠাৎ করে পাঁচ-ছয়জন লোক স্টেনগান ও রাইফেল কাঁধে আমাদের কাছে এসে চুপে চুপে ডাকতে লাগলেন। আমি চোখ মেলে তাকিয়ে তাদের দেখেই ভয়ে জড়োসড়ো হয়ে নিজের শরীরকে আরো গুটিসুটি করে নিলাম। তারা ফিসফিস করে বলতে লাগলেনÑ তোমরা ভয় পেয়ো না, আমাদের খুব ক্ষুধা পেয়েছে, কিছু খাইতে দাও আমাদের। কথা শুনে কিছুটা সাহস পেয়ে বাড়ির ভেতর গিয়ে বাবা ও চাচাকে ডেকে তুলে বিস্তারিত বললাম। বাবা বাইরে এসে তাদের দেখে আলাপ করে বড় বড় দুই গামলা ভর্তি পান্তা (গরমের দিনে গ্রামের লোকেরা পান্তা খেত) তরকারি, কাঁচামরিচ, লবণ ও পেঁয়াজ এনে দিলেন। তারা সবাই গামলাতেই চুপে চুপে খেয়ে সবাইকে বললেন, আমরা যে এসেছিলাম, খাওয়া-দাওয়া করেছি এ কথা কেউ যেন না জানে, এই বলে তারা চলে গেলেন। সবাই খুব দুঃখ পেলেনÑ কি কষ্ট করে তারা যুদ্ধ করছেন। বুঝতে পারলাম তারা মুক্তিযোদ্ধা। আমার বড় ভাই ও এক চাচা ছিলেন স্কুলের শিক্ষক, তারাও মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে ২৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত দীর্ঘ এই নয়টি মাসের প্রতি রাতেই শুনতাম গোলাগুলির শব্দ, মনে হতো কোনো থানা বা জেলা শহরে মুক্তি যোদ্ধাদের সাথে মিলিটারিদের যুদ্ধ চলছে। পরদিন সকালে দেখতাম আমাদের নদীর তীর দিয়ে ৩০-৩৫ জনের মুক্তিযোদ্ধার দল কাঁধে রাইফেল ও স্টেনগান নিয়ে লাইন ধরে কোনো টুঁ শব্দ না করে নীরবে চলে যেতে, কোথায় যায় তা কেউ জিজ্ঞাসা করার সাহস পেতেন না। পাড়ার লোকজন এসে তাদের সারিবদ্ধভাবে যাওয়া দেখতেন। এভাবে প্রায় সপ্তাহেই মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্ন দলের আসা-যাওয়ার দৃশ্য লোকজন দেখতে পেতেন। কোনো কোনো দলে আশপাশের গ্রামের চেনাজানা পরিচিত লোকজনকেও রাইফেল-স্টেনগান কাঁধে দেখা যেত। সে সময় গ্রামের লোকজন চড়া-পাতাড়ে কাজকর্ম কম করতেন, রেডিওতে খবর শুনতেন, লোকজন সব সময় ভয়ভীতি ও আতঙ্কের মধ্যে সময় পার করতেন আর কামনা করতেন কবে দেশ স্বাধীন হবে, ভয়-ভীতি, আতঙ্ক ও বিড়ম্বনা থেকে মুক্ত হবেন।


আরো সংবাদ



premium cement