১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`
পাঠক সংখ্যা

কৌশল

-


Ñআদি চাচা একটা গল্প বলেন।
Ñকী গল্প?
Ñভূতের গল্প বলেন।
Ñরাতের বেলায় ভূতের গল্প শোনে না।
Ñতাহলে একটা গান করেন। গান শুনি।
Ñসুর হবে না। ঠাণ্ডায় গলা বসে গেছে।
Ñমুক্তিযুদ্ধের সময়ে আপনার বিয়ের গল্পটা বলেন।
Ñএটা গল্প না, আমার জীবনের ঘটনা। আমার বিয়ের দিনটি ছিল শনিবার। শুক্রবারে সব আয়োজন শেষ। দেশে যুদ্ধ চলছে, এর ভেতরে আমি বিয়ে করতে যাচ্ছিÑ কিরকম লজ্জার! পরের দিন বউ আনতে যাবো। যথাসময়ে বিয়ের দিন বউয়ের বাড়িতে উপস্থিত। বউ নিয়ে ফিরে আসতে অনেক রাত হয়ে গেল। কয়েকজন মাত্র লোক আমরা। অমাবস্যা রাত। ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাস্তার দুই পাশে ঘন বাঁশঝাড় আর গাছগাছালির কারণে চারপাশটা গাঢ় অন্ধকার। কিছুই দেখা যায় না। একজনের কাছে ব্যাটারিÑটর্চ আছে। একটু পরপর সে জ্বালাচ্ছে, নেভাচ্ছে, আবার জ্বালাচ্ছে। ব্যাটারির চার্জ দ্রুত ফুরিয়ে যাওয়ার কারণে আলো দীর্ঘসময় জ্বালিয়ে রাখা সম্ভব নয়। রাস্তাটা বড় লম্বা। অনেকখানি পথ হেঁটে যেতে হবে। হঠাৎ আমাদের চোখের সামনে জ্বল জ্বল করে আলো জ্বলে উঠল। চোখের সামনে আকস্মিক আলো জ্বলে ওঠায় কাউকে দেখতে পাচ্ছিলাম না। আমাদের ভেতর কেউ একজন ‘বাবারে’ চিৎকার করে উঠল। তার আচমকা চিৎকারে নতুন বউ ভয় পেয়ে আমাকে জাপটে ধরল। আমি বউকে আশ্বস্ত করার ভঙিতে তার পিঠে হাত রাখলাম। আমার চোখের সামনে থেকে আলো সরে যেতেই দেখতে পেলাম চারজন মিলিটারি শয়তান আমাদের দিকে মনোযোগের সাথে তাকিয়ে আছে। জীবনে প্রথম বন্দুক হাতে মিলিটারি দেখে চমকে উঠি। আমাদের দলটি তখনো চুপচাপ দাঁড়িয়ে। আমি মোটেও সাহসী ছিলাম না। এই ভরা বিপদে কী করব, বুঝে উঠতে পারলাম না। প্রাণ বাঁচানোর জন্য নিজেদের ওপর আঘাত আসার আগেই বউয়ের পরনের সব গহনা একটা একটা করে খুলে ফেললাম। এরপর মিলিটারির হাতে দিতে গিয়ে প্রচণ্ড শক্তিতে গালে থাপ্পড় খেয়ে মাটিতে বসে পড়লাম। আমি গালে হাত দিয়ে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম। মিলিটারির চারজনের একজন জিজ্ঞেস করল, কাহা যা রায়ে হো?
আমি ভয় পাওয়া গলায় বললাম, আজ বিয়ে করেছি। বউ নিয়ে বাড়ি যাচ্ছি।
Ñতুম ছব লোক মুক্তি ফৌজ হ্যায়?
আমাদের একজন বলে উঠল, না না, আমরা বরযাত্রী।
আমি তাকে থামিয়ে বললাম, আমি বিয়ে করে বাড়ি ফিরে যাচ্ছি।
Ñতুমহারার নাম বাতাও?
Ñআদি ইমাম।
Ñতুম মুসলিম হ্যায়?
Ñজ্বি, সাচ্চা মুসলমান।
Ñমুক্তি ফৌজ কাহা রেহেতাহে কুচ জানতা হো।
Ñকুচ নেহি পাতা।
Ñডরো মাত, হাম তুম লোগকো কুচ নেহি করেঙ্গে। হামারার সাথ আ যাও।
আমরা মিলিটারি চারজনের সাথে নির্ভয়ে হাঁটতে লাগলাম। হাঁটতে হাঁটতে তাদের কেউ একজন বলতে লাগল, এ আদমি জরুর মুক্তি ফৌজ হ্যায়।
আমরা ভয়ে ভয়ে হাঁটছি। আজই সকালে খবর পেয়েছি পাক হানাদাররা আজ এখানে একজন বাঙালিকে মেরেছে, কাল ও গ্রামে আগুন দিয়েছে। মিলিটারি শয়তানরা মেয়েদের ধরে ধরে ক্যাম্পে নিয়ে যাচ্ছে। সাথে মাত্র বিয়ে করা নতুন বউ। খুব দুশ্চিন্তা হতে থাকে।
রাস্তা শেষ করে আমরা খোলা একটা জায়গায় এসে পৌঁছলাম। এই জায়গায় অন্ধকার আরো বেশি মনে হতে লাগল। এখানে তো আশপাশে বাড়িঘর কিছুই নেই। যদি সত্যি সত্যি এখানে আমাদের গুলি করে মেরে রেখে যায়! ভেবে ভেবে শিউরে উঠছি। সাহায্যের জন্য কেউই আমাদের দিকে এগিয়ে আসবে না। আমাদের চিৎকার চেঁচামেচি কেউ শুনতেই পাবে না। জীবন হারানোর ভয় পাচ্ছি, আর ভয় আর মায়া হলো মেয়েটিকে সাথে নিয়ে চলেছি, আমারই বউ। কে জানে কী ঘটনা ঘটে যাবে জীবনে। মিলিটারি দু’জন বলবান লোক অস্ত্রহাতে রাহাবার হয়ে আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আর দু’জন পেছনে আসছে।
কিন্তু ঘটনা তো একটা ঘটবারই ছিল এবং এরকম ঘটনার জন্য আমরা সবাই ছিলাম অপ্রস্তুত। মিলিটারি চারজন এলোপাতাড়ি বুটের লাথি আর ঘুষি মারতে মারতে আমাদের কয়েকজনকে মাটিতে ফেলে দিলো। অকল্পনীয় এমন দৃশ্যে নতুন বউ চিৎকার করে উঠে দ্বিতীয়বারের মতো আমাকে জাপটে ধরল। আমি কী করব! বিপদের সময় মাথা ঠিক থাকে না। ভয়ে আমিও বউকে জাপটে ধরে থাকলাম। সেদিন আমরা শুধু দু’জনই মার খাওয়া থেকে বেঁচেছি। বাকিরা সবাই মাটিতে যন্ত্রণায় গড়িয়েছে। মিলিটারি চারজন আমার কাছ থেকে সব গহনা আর টাকা পয়সা নিয়ে অন্ধকারে মিশে গেল। যাওয়ার সময় একজন খুব গম্ভীর গলায় যেতে যেতে বললÑ কাজটা সেখানেই সারতে পারতাম। বাড়ি-ঘরের সামনে চিৎকার করবি বলে একটু দেরি হয়ে গেল। ভাগ তাড়াতাড়ি। এখান থেকে সরে যা। অন্য ডাকাতের হাতে পড়লে দিতে কিছু না পারলে একেবারে জানে মেরে ফেলবে!
মন খারাপ করে সেদিন রাতে বাড়িতে এসে পৌঁছলাম। সান্ত্বনা শুধু এটুকু নতুন বউয়ের ক্ষতি হয়নি।
Ñআচ্ছা চাচা, মিলিটারি সেজে ডাকাতি করল। ডাকাতদের সাধারণ কৌশলে আপনারা ধরা খেয়ে গেলেন।
Ñখারাপ কাজে বুদ্ধি খাটানো পাপ। আল্লাহ বুদ্ধিকে নষ্ট করে দেন। দুনিয়া এবং আখিরাতে সবচেয়ে বড় কৌশলকারী হলেন আল্লাহ।
নবাবগঞ্জ, ঢাকা।


আরো সংবাদ



premium cement