২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ক্যালিগ্রাফার উসামা হক

-

শখের কাজের প্রতি যদি ভালোবাসা, ভালোলাগা, যতœ থাকে। তাহলে সফলতা পেতে খুব একটা দেরি হয় না। শখ আর কৌতূহলের বসে শুরু করেছিলেন ক্যালিগ্রাফি। কিন্তু অল্প সময়ে ক্যালিগ্রাফিতে সবার নজর কেড়েছেন তিনি। একাধিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ক্যালেন্ডারে তার ক্যালিগ্রাফি, দেশের বাইরে প্রতিযোগিতায় ফাইনাল রাউন্ডে পৌঁছা, দেশ বিদেশের প্রখ্যাত ক্যালিগ্রাফারদের প্রশংসা পেয়েছেন তিনি। নন্দিত এই ক্যালিগ্রাফার এর নাম উসামা হক। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগে মাস্টার্স পড়ছেন। পরিবারে তিন ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবচেয়ে বড়। থাকেন গাজীপুরে। ক্যালিগ্রাফির শাব্দিক অর্থ সুন্দর লেখা। ভাষাকে শৈল্পিকভাবে লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশ-ই ক্যালিগ্রাফি। ছোটবেলা থেকেই তার আর্টের প্রতি ঝোক। তখন তৃতীয় শ্রেণীতে পড়েন। অতিরিক্ত বিষয় হিসেবে নেন আর্ট। বড় ভাই আহমদ রেজা ফারুকী তাকে ক্যালিগ্রাফি শেখান। মূলত তার হাতেই ক্যালিগ্রাফির হাতে খড়ি হয় উসামা হকের। উসামা বলেন, আহমদ রেজা ফারুকী ভাইয়ের কাছ থেকে শেখা শুরু করি। অক্ষরের শেপ, শব্দ তৈরি এবং পরবর্তীতে বাক্য কম্পোজিশন, রঙের ব্যবহার তার কাছ থেকেই শিখেছি। এরপর নিসার উদ্দিন জামিল, আবদুর রহিম, বাংলাদেশের খ্যাতিমান ক্যালিগ্রাফার মাহবুব মুর্শিদ স্যার ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিংয়ের ব্যাপারে পরামর্শ দেন। ক্যালিগ্রাফার মাহবুব মুর্শিদ ওয়ার্কশপ এর আয়োজন করেন। সে ওয়ার্কশপে অংশগ্রহণ করার সুযোগ হয় উসামার। ওয়ার্কশপ যেন উসামার চোখ খুলে দেয়। তিনি বলেন, ওয়াকশর্পে অংশ নেয়ার পর আমার কাজে পরিবর্তন আসে! ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং নতুন করে বুঝতে পারি এবং শুরু হয় আমার ক্যালিগ্রাফি নিয়ে স্বপ্ন দেখা। ক্যালিগ্রাফিতে সাধারণত কী লিখেন? ক্রেতা যা বলে দেয় তাই না, পবিত্র কুরআনের আয়াত? উসামা বলেন, ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিংয়ে যেকোনো বাক্যই লিখি। তবে পবিত্র কুরআনের আয়াতগুলো ক্যালিগ্রাফি হিসেবে অসাধারণ হয় তাই সেগুলো বেশি করা হয়। এ ছাড়াও বাংলা ক্যালিগ্রাফি করে থাকি। অনেকে বিয়েতে নবদম্পতির নাম ক্যালিগ্রাফি উপহার হিসেবে দিতে চায়, সেগুলোও করে দেই। ক্যালিগ্রাফির কাজ করছেন তিনি প্রায় ১৪-১৫ বছর। তবে পেশা হিসেবে নিয়েছেন বছর দুয়েক হবে। তিনি গ্রাফিকস ডিজাইন, বিজনেস কার্ডের কাজও করে থাকেন। আরবি, বাংলা ও ইংরেজি এ ভাষাগুলোতে ক্যালিগ্রাফি করেন। দোহাতে অনুষ্ঠিত উঙঐঅ ঙওঈ ণঙটঞঐ ঈঅচওঞঅখ ওঘঘঙঠঅঞওঙঘ অডঅজউ প্রতিযোগিতায় ফাইনাল রাউন্ড পর্যন্ত টিকে ছিল উসামার ক্যালিগ্রাফি। তিনি জানান, নিউ ইয়র্কে এক মসজিদের জন্য তার চারটি ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং নেয়া হয়েছিল। সোনালী ব্যাংকের এ বছরের ক্যালেন্ডার উসামার ক্যালিগ্রাফি দিয়ে করা হয়েছে।
উসামার মতে, ক্যালিগ্রাফির বাণিজ্যিক সম্ভাবনা রয়েছে। মানুষ এখন অফিস, বাসাবাড়ি, হল রুম সাজানোর জন্য পেইটিং ব্যবহার করে। এ ক্ষেত্রে ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের কাছে আরবি ক্যালিগ্রাফি প্রাধান্য পেয়ে থাকে। ক্যালিগ্রাফিকে পেশা হিসেবে বেকার যুবকরা নিতে পারে কি না? এমন প্রশ্নের জবাবে উসামা বলেন, ক্যালিগ্রাফি পেশা হওয়ার আগে শখ হতে হবে। এ কাজে প্যাশন থাকলে এবং কাজ ভালো পারলে তখন পেশা হিসেবে ক্যালিগ্রাফিকে গ্রহণ করা সম্ভব। এ ছাড়া ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিংস এ মেটেরিয়ালসের জন্য ভালো খরচ হয় তাই এটাতে প্যাশন না থাকলে পেশা হিসেবে এটাকে নিয়ে টিকে থাকাটা বেশ কঠিন। বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফির বাজার খুব একটা বড় নয় বটে। তবে বিশ্ববাজারে ক্যালিগ্রাফির প্রচুর চাহিদা রয়েছে। বিশেষ করে আরব দেশগুলোতে। আরবরা ক্যালিগ্রাফি রাখাকে তাদের অভিজাত্য, সৌন্দর্যের প্রকাশ বলে মনে করেন। উপযুক্ত মাধ্যম পেলে ক্যালিগ্রাফি রফতানি করে বিপুল বৈদেশিক মুদ্্রা অর্জন করা সম্ভব। উসামা বলেন, ক্যালিগ্রাফির কাজ বিদেশে রফতানি করার অসীম সুযোগ রয়েছে। ভালো কোনো মাধ্যম পেলে বিদেশে ব্যাপক পরিমাণে ক্যালিগ্রাফির কাজ রফতানি করা সম্ভব। ক্যালিগ্রাফিতে বর্তমানে বিশ্বে ভালো করছে তুরস্ক, ইরান, মিসর। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে আমাদের কাজ এখন চোখে পড়ার মতো! আমাদের দেশে ক্যালিগ্রাফি এখন পেইন্টিংয়ের আদলে চর্চা করা হচ্ছে, যার জন্য অন্যান্য দেশের শিল্পীরা আমাদের কাজ ফলো করছে। এক্রেলিক ও ওয়াটার কালারÑ এ দুই মাধ্যমেই বেশি ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং করেন তিনি। সাইজ, কাজ অনুযায়ী দাম নির্ধারণ হয়। সেটা পাঁচ হাজার থেকে শুরু করে লাখ টাকাও হতে পারে বলে উসামা জানান। উসামার অসংখ্য কাজ ব্যাপক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। উসামা বলেন, আরবি ক্যালিগ্রাফির মধ্যে ‘রাব্বির হামহুমা কামা রাব্বায়ানি সাগিরা’ আমার এ কাজটি বেশ জনপ্রিয় ও প্রশংসিত হয়। এ কাজটি ‘৪ঃয ঞঁহব ড়ভ অৎঃ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ অৎঃ ঋবংঃরাধষ ২০১৯’ প্রদর্শনীতে স্থান পায়। ‘আমি বাংলায় কথা কই’ উসামার আরেকটি সাড়াজাগানো কাজ। তিনি এই লেখার ফন্ট নিজে তৈরি করেন। ফন্টের শেপের আলাদা বৈশিষ্ট্যর কারণে ক্যালিগ্রাফি মাস্টার মাহবুব মুর্শিদ এই কাজের ভূয়সী প্রশংসা করেন বলে উসামা জানান। প্রচণ্ড উদ্ভাবনী শক্তির অধিকারী উসামা। তিনি অসংখ্য ফন্ট স্টাইল তৈরি করেছেন, যা আরবি অন্য কোনো স্টাইলের সাথে একদমই মিলবে না। এ ধরনের একটি কাজ হলো তার মা-বাবার ৩৩তম জন্মদিনে তাদেরকে উপহার দেয়া একটি ক্যালিগ্রাফি।
ফেসবুকে উসামার পেজের নাম ঐধয়ঁব অৎঃ এধষষবৎু। এই পেজের মাধ্যমে কাজের অর্ডার দেয়া যায়। এখানে উসামার প্রচুর কাজ দেয়া আছে। আবার উসামা হক নামে ফেসবুক অ্যাকাউন্টে বার্তা পাঠিয়ে অর্ডার দেয়া সম্ভব। কাজের ক্ষেত্রে অর্ডার দেয়ার পর অর্ধেক টাকা অগ্রিম নেন বলে উসামা জানান। ঢাকার বাইরে হলে কুরিয়ারে পণ্য ডেলিভারি করেন। তিনি এ পর্যন্ত ৭টি প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করেছেন। উসামার কাজ দেশ বিদেশের আর্টিস্টদের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। বাংলাদেশের মাস্টার আর্টিস্ট মাহবুব মুর্শিদ তার কাজের ব্যাপারে বলেন, ‘উসামা হক, বাংলাদেশে ক্যালিগ্রাফি পেইন্টিং চর্চায় নবীন শিল্পীদের মধ্যে অন্যতম। ক্যালিগ্রাফির সৌন্দর্য বিন্যাসে যতগুলো প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি আছে তার প্রায় সবই এখন উসামার দখলে। বিশেষ করে খত বা লিপির আকার-আকৃতি, ক্যালিগ্রাফি কম্পোজিশন সর্বোপরি কালার নির্বাচন বা লেপন এসবে উসামা বিশেষভাবে পারদর্শী!
আন্তর্জাতিক চায়নিজ ক্যালিগ্রাফার হাজী নুরুদ্দিন বলেন, ‘উসামার সুলুস খতের (আরবি লেখার একটা স্টাইল) হাত ভালো, এটা নিয়ে কাজ করলে আরো ভালো করতে পারবা। ‘৪ঃয ঞঁহব ড়ভ অৎঃ ওহঃবৎহধঃরড়হধষ অৎঃ ঋবংঃরাধষ ২০১৯’ এ ভারত থেকে আন্তর্জাতিক ওয়াটার কালার মাস্টার আর্টিস্ট প্রবীণ কর্মকার এসেছিলেন। তিনি উসামার কাজ দেখে বলেন, ‘তোমার হাত নিখুঁত এবং কালার সেন্স খুবই ভালো, তোমার বয়স এখনো বেশি হয়নি অনেক সময় আছে কাজের মধ্যে থাকলে অনেক ভালো করতে পারবা। ক্যালিগ্রাফার আবদুর রহিম বলেন, উসামার কাজে সাবজেক্ট ও অবজেক্ট, ফন্ট ও মটিফ, কালার ও শেড, সব কিছুতে মিলতাল হয়েছে। নবীনদের কাজে এসব বিষয় যত বেশি চর্চা হবে, শিল্প তত এগিয়ে যাবে।

 


আরো সংবাদ



premium cement