২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

হিল জুতা

চারাগল্প
-

ঘরে নাশতা পানির এলাহিকাণ্ড চলছে। পাত্রপক্ষ আজ শিউলিকে দেখতে আসবে। ছেলের বাড়ি ভদ্রগাঁও। স্কুলে শিক্ষকতা করেন। নাম রনি।
সাদা পাঞ্জাবি পরে বারান্দার চেয়ারে বসে আছেন রহিম সাহেব। তিন মেয়ের মধ্যে বড় দুই মেয়েকে আগেই বিয়ে দিয়েছেন তিনি। তারা সুখে আছে। ছোট মেয়ে শিউলির বয়স এবার ২৭। গ্রামবাংলায় এই বয়সের মেয়েকে সমাজের নিন্দুকেরা আড়াল থেকে সাধারণত ‘আইবুড়ি’ বলে তিরস্কার করে। ২৭ বছরের এই জীবনে সেসব নিন্দুকের কম তিরস্কার সহ্য করেনি শিউলি। ‘আইবুড়ি’র পর যে অপবাদটি সবচেয়ে বেশি শুনতে হয়েছে শিউলিকে, সেটি হলো ‘বেঁটে’।
জন্মের পর আশ্চর্য রকম সুন্দর চেহারা আর ধবধবে ফর্সা গায়ের রঙ নিয়ে পৃথিবীতে এসেছে শিউলি। রহিম সাহেব ফুলের মতো দেখতে এই মেয়ের নাম রাখেন ফুলের নামে। শিউলি।
শিউলি বড় হতে থাকে। বুদ্ধিদীপ্ত আর দারুণ মেধার কারণে সে বরাবরই ক্লাসেও ছিল সেরা ছাত্রী। গুণবতী হিসেবেও শিউলির সুনাম আছে। ভালো রান্না, নকশিকাঁথা বোনা, সুর করে কুরআন পড়তে পারা, অসাধারণ চা বানানো, ছবি আঁকাÑ এসব প্রতিভা দিয়েই সবাইকে মুগ্ধ করে সে। সঠিক বয়সে বিয়ের উপযুক্ত সময়ে এসে রহিম সাহেব বুঝতে পারেন তার এই মেয়েকে বেঁটেই বলা চলে। লম্বা নয়। ফলে একে একে ভালো ঘর থেকে আসা বিয়ের সম্বন্ধগুলো ক্রমান্বয়ে বাতিল হতে থাকে। পাত্রীর রূপ সৌন্দর্য, শিক্ষাদীক্ষা বা গুণের প্রতি ছেলেপক্ষের অভিযোগ না থাকলেও শিউলির শারীরিক উচ্চতার মাপকাঠি দেখে তার বিয়ের ফুল ফোটার আগেই ঝরে যেতে থাকে। উচ্চতায় কেবল বেঁটে হওয়ার কারণে তার সব প্রতিভা, গুণ, মেধা, শিক্ষা, যোগ্যতাগুলোকে এই শিক্ষিত সমাজের মাথাওয়ালা মানুষগুলো অবহেলায় মূল্যায়ন করতে থাকে। যতবার বিয়ের সম্বন্ধ বাতিল হয়, ততবার শিউলির মানসিক আঘাত বাড়তে থাকে। নিজেকে মনে হতে থাকে পরিবারের বোঝা আর সমাজের অবাঞ্ছিত একজন।
সময়ের পাল্লায় বিয়ের বয়স ভারী হতে দেখে বিচলিত হয়ে ওঠেন রহিম সাহেবও। মেয়ের বিয়ের সম্বন্ধ বাতিল হলেই তিনিও ভেঙে পড়েন। ভেবে দেখেনÑ মেয়ে তো রূপ, গুণ আর শিক্ষায় এগিয়ে। শুধু সমস্যাটা হলো মেয়ের উচ্চতা।
গতকাল রহিম সাহেব মার্কেট ঘুরে একজোড়া হিল জুতা কিনলেন শিউলির জন্য। তিনি মনে করেন এই হিল জুতা পরলে মেয়েকে খানিক লম্বা দেখাবে। পাত্রপক্ষের চোখে না পড়লেই হয়। গতকাল বাবার এমন কাণ্ডে লজ্জা পেল শিউলি। ছাদে গিয়ে নীরবে কিছুক্ষণ কেঁদেছেও।
২.
ঘরভর্তি মেহমান। রনি তার দুই বোন আর দুলাভাইদের নিয়ে পাত্রী দেখতে এসেছেন। সোফায় বসে আছেন সবাই। দুনিয়ার নাশতা-পানি তাদের সামনে। রহিম সাহের মুগ্ধ হয়ে বারবার রনিকে দেখছেন। আগে যতগুলো ছেলে এসেছে, তাদের থেকে রনি দেখতে সব থেকে ভালো। চেহারায় একটা মায়া মায়া ভাব আছে। পাত্র হিসেবে এই ছেলেকে বড় পছন্দ হলো রহিম সাহেবের।
পাত্রপক্ষের সামনে আনা হলো শিউলিকে। নীল শাড়ির লম্বা ঘোমটায় মুখ ঢেকে থাকা শিউলি দাঁড়িয়ে আছে। হিল জুতায় তাকে এখন বেঁটে দেখাচ্ছে না। মা আগেই শাড়ির নিচের পাড় দিয়ে পা দু’খান ঢেকে দিয়েছেন, যাতে হিল জুতা পাত্রপক্ষের নজরে না পড়ে।
ঘোমটা সরানোর পর শিউলিকে রনির দুই বোন আর দুলাভাইদের পছন্দ হলো। কিন্তু পাত্রপক্ষের সামনে থেকে বিদায় নিতেই রনির বড় বোনের চোখ কিভাবে যে চলে গেল শিউলির পায়ের হিল জুতায়। ফলে বড় বোনের বিশেষ অনুরোধে শিউলির পা থেকে যখন হিল জুতা জোড়া খুলে ফেলা হলো, তখন শিউলিকে যে খাটোই লেগেছে। রনির বড় দুলাভাই মুখের ওপর বলে দিলেন, ‘মেয়ে তো একেবারে বেঁটে।’ রহিম সাহেব আহত চোখে রনির দুলাভাইয়ের দিকে তাকিয়ে রইলেন। আর লজ্জায় তো শিউলির মরি মরি অবস্থা।
৩.
রাতে মা-বাবার কথোপকথন আড়াল থেকে কানে এলো শিউলির। বাবা করুণ গলায় মাকে বলছেন, ‘রনির দুলাভাই ফোন করেছে। ওরা শিউলিকে পছন্দ করলেও বেঁটের কারণে বিয়ে করাতে রাজি নয়। হিল জুতা না দেখলে শিউলির এখানেই বিয়েটা হয়ে যেত। জুতা জোড়া আলমারিতে ভরে রেখেছি। পরেরবার সম্বন্ধ এলে সতর্ক থাকতে হবে শিউলিকে, যাতে ছেলেপক্ষ হিল জুতার খবর ভুলেও টের না পায়।’
শিউলির বুকটা ভেঙে উঠল। হিল জুতা নিয়ে ভুল চিন্তা করছেন বাবা। কৌশলে হয়তো পাত্রপক্ষের চোখকে ফাঁকি দেয়া যাবে পায়ের হিল জুতা থেকে, কিন্তু সংসার জীবনের অনাকাক্সিক্ষত কলহে যে ‘বেঁটে’ অপবাদ সারাজীবন শিউলিকেই সহ্য করতে হবে।
পরদিন সকালে মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে আলমারিতে বাবার যতœ করে তুলে রাখা হিল জুতা জোড়া কৌশলে বের করে এনে পুকুর পাড়ে চলে আসে শিউলি। তার পর উঁচু হিল জুতা জোড়া মধ্য পুকুরে ছুড়ে ফেলতেই সেটা পানিতে তলিয়ে গেল।
ঘরে এসে মোবাইলটা হাতে নিতেই শিউলি দেখে একটা আননোন নম্বর থেকে মেসেজ এসেছেÑ ‘শিউলি, আমি রনি। তোমাকে আমার ভীষণ পছন্দ হয়েছে। আমি তোমাকেই বিয়ে করব। লম্বা-বেঁটে, কালো-ফর্সা, সুন্দরী-বদসুরতÑ এগুলো আসলে বৈষম্য। আমি একজন শিক্ষক। এগুলো আমি বিবেচনা করি না। তোমাকে আমার ভালো লেগেছে, ব্যস। ভাবছ তোমার ফোন নম্বর কোথায় পেয়েছি, না? নম্বর কোথায় পেয়েছি, সেটা বলব না। শুধু বলব, কাউকে ভালো লাগলে তার নম্বর কেন শুধু, মনও দখল করা যায়।’
একবার নয়, দু’বার নয়, শিউলি বারবার রনির মেসেজ পড়ে। যতবার পড়ে, ততবার চোখ পানিতে ভেসে যায়। বড় সুখে। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement