২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

অপেক্ষা

চারাগল্প
-

অশীতিপর আলিম সাহেব বয়সের ভারে অনেকটাই ন্যুব্জ। পাঁজরের হাড়গুলোও কেমন যেন দুর্বল হয়ে গেছে। শরীরের ভার বইতে পারছে না। লাঠিতে ভর দিয়ে তাকে চলাফেরা করতে হয়। অসুখ-বিসুখ যেন তার শরীরে স্থায়ীভাবে বাসা বেঁধেছে। এ জীবনে আলিম সাহেবের দেয়ার মতো আর কিছু নেই। সে এখন শুধুই পরিবারের বোঝা। তাই অসুখ-বিসুখে বিছানায় পড়ে থাকলে তেমন কেউ সেবাযতœ করে না। তার কোনো কিছুর প্রয়োজন আছে কি না কেউ জানতেও চায় না। পরিবারের সবাই তার কথাবার্তা ও কাজকর্মে ভুল ধরে। যখন তখন ঝাড়ি মারে। নাতি-নাতনিরাও তাকে সঙ্গ দেয় না। এড়িয়ে চলে। তার রোগগুলো নাকি ছোঁয়াচে। কাছাকাছি থাকলে তার শরীর থেকে অন্যদের শরীরে ছড়িয়ে যেতে পারে। তাই সবাই তাকে ভয় পায়। দূরে দূরে থাকে। বড় ছেলের বউ প্রায় তার ছেলের সাথে ঝগড়া করে। সে অভিযোগ করে বলে ‘সব কাজ আমাকে করতে হবে কেন? তোমার ছোট ভাইয়ের বৌ কী করে? তিনি কি লাট সাহেবের বেটি? তার কাজ ঢাকায় থাকা। কোনো দিন দেখলাম না শ্বশুরকে কিছু দিনের জন্য নিয়ে গেল। আমি এসব বোঝা টানতে পারব না।’ আলিম সাহেব শুনেও না শোনার ভান করে। বুকের মধ্যে আগুন জ্বলে ওঠে। সেই আগুনের তাপ চোখের সব পানি শুষে নেয়। সব কিছু মুখবুজে সহ্য করে। তাই আলিম সাহেবের দুই চোখ কেউ অশ্রুসজল হতে দেখে না। বাইরে থেকে কেউ বুঝতে পারে না ভেতরের কষ্টকে।
উঠানের একপ্রান্তে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা আছে। তার ঠিক পেছনে এক পুকুর রয়েছে। বর্ষাকাল ছাড়া সেই পুকুরে কোনো পানি থাকে না বললেই চলে। সেখানেই এক কামরার একটা টিডশেড তোলা হচ্ছে। ছেলে সামীর যুক্তি ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে, তাদের জন্য রুম লাগবে। তা ছাড়া কেউ বেড়াতে এলে তাদের খুব সমস্যায় পড়তে হয়। দিন দশেকের মধ্যে ঘর নির্মাণ শেষ হয়। সামী শহর থেকে সস্তায় একটা চৌকি ও একটা টেবিল কিনে আনে। দিনের বেলায় ঘরটা সবাই ব্যবহার করে কিন্তু রাতে সেই ঘরে কেউ থাকে না। এভাবেই চলতে থাকে মাসদুয়েক। একদিন বৌমা আলিম সাহেবকে বলে, ‘আব্বা, আপনি তো এশার নামাজের পরপর শুয়ে পড়েন। ছেলেমেয়েরা রাত জেগে পড়াশোনা করে। এতে আপনার ঘুমের অসুবিধা হয়। নতুন ঘরটা তো পড়েই থাকে। তাই বলছিলাম, আপনি ইচ্ছা করলে ওখানে থাকতে পারেন। আরামে ঘুমাতে পারবেন। কেউ আপনাকে ডিস্টার্ব করবে না।’ আলিম সাহেবের কানের পর্দায় আছড়ে পড়ছিল বৌমার কথাগুলো। তা হলে তার অনুমানটাই এত দিনে সত্য হলো। তার জন্যই এই ঘরটা নির্মাণ করা হয়েছে। সবার মাঝে তাকে আর রাখা যাবে না। কিছ্ক্ষুণ চুপ থেকে আলিম সাহেব ভাঙা কণ্ঠে বলে, ‘ঠিকই বলেছ। আমার জন্য ঘরটা যুতসই হবে। কাল থেকে আমিই থাকব ওই ঘরে।’ আলিম সাহেবের মতামতটা শোনার পর বৌমার চোখে মুখে একটা আনন্দের ঢেউ বয়ে যায়। মনে হচ্ছিল সে যেন যুদ্ধ করে রাজ্য জয় করে বাড়ি ফিরেছে। পরদিন থেকে ওই টিনশেডই হয় আলিম সাহেবের থাকার ব্যবস্থা।
টিনশেডে আলিম সাহেব গরমকালটা কোনো রকমে পার করেছে ঠিকই কিন্তু শীতকালটা আর পার করতে পারছে না। দীর্ঘ রাত তাকে একা একা থাকতে হয়। শীতকালে ঠাণ্ডা কাশি বেড়ে যায়। টিনশেডে বড্ড শীত করে। লেপ-কাঁথা মুড়ি দিয়েও শীত যায় না তার। একাকিত্ব বুকের যন্ত্রণা অনেকখানি বাড়িয়ে দেয়। স্ত্রীকে তার খুব মনে পড়ে। একসময় এই শীতকালই আসত আলিম সাহেবদের কাছে আশীর্বাদ হয়ে। আর আজ ঠিক তার উল্টো। একা থাকতে গা ছমছম করে। রাতের বেলায় সে চোখে ঠিকমতো দেখে না। ঘর থেকে টয়লেটটা খানিকটা দূরে। ক’দিন আগে টয়লেটে যেতে গিয়ে পড়ে গিয়েছিল। বড্ড ব্যথা পেয়েছে। সে ব্যথা সবসময় অনুভব করে। এক রকম বাধ্য হয়েই ছেলেকে আলিম সাহেব বলে, ‘রাতের বেলা খুব শীত করে। টিনের গা বেয়ে পানি পড়ে। শ্বাসকষ্ট আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে। তা ছাড়া রাত-বিরাতে টয়লেটে যাওয়া আমার পক্ষে কষ্টকর। তাই বলছিলাম কী শীতের কয়েকটি দিন আমি আগের মতো তোদের সাথেই থাকি।’ ‘আপনি চিন্তা করবেন না। আমি আগামীকালই সিলিং-এর ব্যবস্থা করে দেবো। আপনার যখন টয়লেটে যাওয়ার দরকার হবে তখন আমাকে ডাকবেন। আমি নিয়ে যাবো। এ নিয়ে একদম চিন্তা করবেন না।’ কংক্রিটের পাকা ঘরে আলিম সাহেবের যে আর ঠাঁই নেই তা বুঝতে তার কষ্ট হয়নি। বাট-বেটা যখন উঠোনে দাঁড়িয়ে কথা বলছিল, তখন আলিম সাহেবের কানে ভেসে আসেÑ দু’দিন পরে যে কবরে যাবে তার আবার ভয়! সেই নারী কণ্ঠ ছিল তার ছেলের স্ত্রীর। ‘ঠিকই তো আমার আবার ভয় কিসের? দু’দিন পরে তো অন্ধকার কবরে আমাকে একাই থাকতে হবে। আমার তো উচিত সেই দিনটির জন্য অপেক্ষা করা।’ মনে মনে কথাগুলো উচ্চারণ করে আলিম সাহেব নিজেকে ধিক্কার দিতে দিতে টিনশেডের দিকে হাঁটা দেয়।
সপ্তাহ পেরিয়ে যায় তবুও সামী বাবার টিনশেডের ঘরটি সিলিং করে দেয় না। কয়েক দিন ধরে রাতের বেলায় আলিম সাহেবের শ্বাসকষ্টটা ভীষণরকম বেড়ে যায়। তখন মনে হয় এই বুঝি তার দম বন্ধ হয়ে গেল। ছেলেকে কষ্টের কথা বলার সাহস পায় না। দম বন্ধ হলে কারোর কিছু এসে যায় না। বরং তাদের মাথা থেকে একটা বোঝা নেমে যাবে। আলিম সাহেবের শরীরটা মোটেই ভালো যাচ্ছে না। ছোট ছেলের কথাও খুব মনে পড়ছে। তাকে দেখার জন্য বাবার মনটা আনচান করছে। এক বছরের মধ্যে তার সাথে দেখা হয়নি। এনজিওতে চাকরি করে। কাজের ভীষণ চাপ। তাই ছুটি নিতে পারে না। দু’দিন পরে আলিম সাহবের শরীরের অবস্থা আরো খারাপ হয়। সেদিন কোনোরকমে এশার নামাজ পড়ে শুয়ে পড়ে। স্ত্রী মালিহার কথা তার খুব মনে পড়ে। তার কাছে যাওয়ার জন্য মনটা আনচান করতে থাকে। অভিমান করে বলে, আমাকে একা ফেলে তুমি স্বার্থপরের মতো সুখের ঠিকানায় পাড়ি দিয়েছ? ভাবছ সহজে তোমার কাছে যেতে পারব না? সব মিথ্যে মালিহা। সব মিথ্যে। আমি শিগগিরই তোমার কাছে চলে যাবো। আমি যে পারছি না তোমাকে ছেড়ে একা থাকতে। মাঝ রাতে তার শ্বাসকষ্টটা আরো বেড়ে যায়। তার সাথে প্রেশারটাও বেড়ে যায়। চোখে ঝাপসা দেখে। মনে হয় স্ত্রী তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। শরীরটা অনবরত ঘামছে। শক্তি নেই চিৎকার দিয়ে সামীকে ডাকবে। অবশেষে যা হওয়ার তাই হলো। যার জন্য সবাই অপেক্ষা করছিল। সেদিনই সে সবাইকে খুশি করে পাড়ি জমায় পরপারে। আর কখনো কাউকে কষ্ট দিতে আসবে না। হ

 


আরো সংবাদ



premium cement