২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হার না মানা হাফিজুর রহমান

-

হাফিজুর রহমান দেখিয়ে দিয়েছেন মানুষের অদম্য সাহস, প্রবল ইচ্ছাশক্তি ও আত্মবিশ্বাস থাকলে সহজেই সফলতার সর্বোচ্চ চূড়ায় পৌঁছানো যায়। হাফিজুর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে সদ্য মাস্টার্স শেষ করেছেন। জন্মগতভাবে বিকল হাত-পা। তাতে কী! মুখ দিয়ে লিখে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর দুটোতেই পেয়েছেন ফার্স্ট ক্লাস।
হাফিজুরের জন্ম বগুড়া জেলার ধনুট উপজেলার বেলকুচি গ্রামের এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে। চার ভাইয়ের মধ্যে হাফিজুর সবার ছোট।
ছোটবেলায় হাফিজুরের সাধ জাগে লেখাপড়া করার। বাবার কাছে বাংলা-ইংরেজি বর্ণমালা শেখেন। ছেলের আগ্রহ দেখে বাবা ব্র্যাক স্কুলে ভর্তি করান। কিন্তু তার পক্ষে একা স্কুলে যাওয়া সম্ভব ছিল না। পরে সাইকেলের বিয়ারিং দিয়ে বাবা তাকে একটি ছোট্ট গাড়ি বানিয়ে দেন। সেটিতে রশি বেঁধে সহপাঠীরা তাকে টেনে আনা-নেয়া করত।
স্কুল আসা-যাওয়ার কষ্ট দেখে শিক্ষকরা তাকে বাড়িতে লেখাপড়া করার পরামর্শ দেন। শিক্ষকের কথামতো হাফিজুর বাড়িতে বসে লেখাপড়া করেন। তবে মাঝে মধ্যে স্কুলে যেতেন। এভাবে প্রাথমিক পর্যায় শেষ করে ভর্তি হন ধুনট এনইউ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখানেও শিক্ষকরা বাড়িতে থেকে লেখাপড়া করার কথা বলেন। শুধু পরীক্ষার সময় স্কুলে যেতেন হাফিজুর।
এ ভাবেই সংগ্রাম করে লেখাপড়া চালিয়ে যান তিনি। অষ্টম শ্রেণীতে পড়ার সময় নতুন চিন্তা আসে হাফিজুরের মাথায়। পা দিয়ে লেখার পরিবর্তে মুখ দিয়ে কলম ধরতে থাকেন। এরপর মুখ দিয়ে কলম ধরে লিখেই ২০০৯ সালে ধনুট এনইউ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে জিপিএ ৪.১৯ এবং এইচএসসি ধনুট ডিগ্রি কলেজ থেকে জিপিএ ৩.৬০ অর্জন করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার স্বপ্ন নিয়ে ঢাকা আসেন হাফিজুর। ঢাকা আসাটা হাফিজুরের জন্য সহজ ছিল না। এলাকার অনেকেই বলতেন, তোমার পক্ষে উচ্চশিক্ষা নেয়া সম্ভব নয়, অন্য কোনো পরিকল্পনা করতে। কিন্তু তখন তাদের কথা নীরবে শুনে গেছেন এই অদম্য তরুণ। তার কষ্ট বৃথা যায়নি। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির কোচিং করতে না পারলেও চান্স পেয়েছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে। আজ হাফিজুর মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। এটা জেনে তার এলাকার অনেকেই গর্ব বোধ করেন।
বেঁচে থাকার তাগিদে, নিজের পড়াশোনা খরচ, মা-বাবাকে সহযোগিতা জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটকে জবির লোগোসম্বলিত কিছু টি-শার্ট, হুডি, ব্যাগ ও বগুড়ার দই শিক্ষার্থীদের মাঝে বিক্রি করেন।
পাশাপাশি মানসম্মত চাকরিপ্রাপ্তির প্রত্যাশায় সাধ্যানুযায়ী পড়ালেখা চালিয়ে যাচ্ছেন।
হাফিজুর বলেন, ‘বন্ধুরা যখন লাইব্রেরিতে বসে চাকরির পড়ালেখায় মনোনিবেশ করছে, আমি তখন দুটো টি-শার্ট বিক্রির জন্য ব্যস্ত। আমি জানি না, আমার এই দুঃসহ জীবনের শেষ কোথায়!
যেখানে টি-শার্ট বিক্রি করে দৈনিক জীবনযাপনে আমি শ্রান্ত; অথচ ওদিকে গ্রামের বাড়িতে বার্ধক্য ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত বাবা ও বৃদ্ধা মা ন্যূনতম খেয়ে পরে জীবনযাপনের জন্য আমার মতো সন্তানের কাছেই কিছু আশা করছেন। বৃদ্ধ বাবা-মায়ের কষ্টের কথা মনে হলে নীরবে নিভৃতে চোখের পানি উৎসর্গ করা ছাড়া আর তেমন কিছুই করার থাকে না আমার।’
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের উদ্দেশে হাফিজুর বলেন, ‘আমাদের উচিত প্রথমে নিজের লক্ষ্য স্থির করা। আর লক্ষ্য মতে এগিয়ে যাওয়া। তাহলে আমরা সমাজের বোঝা হয়ে থাকব না।’


আরো সংবাদ



premium cement