১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

হেঁটে চিকিৎসা দেন ডাক্তার ওমর ফারুক

জীবনের বাঁকে বাঁকে
-

অন্যসব পল্লী চিকিৎসকের মতো বসেন না কোনো নির্দিষ্ট ফার্মেসিতে। নেই কোনো নিজস্ব চেম্বার। নেই কোনো বাইসাইকেলও। তাতে কি, সুনামের সাথেই চালিয়ে যাচ্ছেন চিকিৎসা নামক মহান কাজ। বগলে একটা ছাতা, জোড়াতালি দেয়া একটি ব্যাগ, জীর্ণ-শীর্ণ পোশাক, উসকোখুসকো চুল। দিন নেই রাত নেই চলতেই থাকে হাঁটা নামক দুরূহ কাজ। নড়াইল জেলার অন্তর্গত সিঙ্গিয়ার বণিকপাড়া সবাই কলুপাড়া নামেই চিনে থাকেন। বলছি ডাক্তার মো: ওমর ফারুকের কথা। ডাক্তারি জীবনের শুরুতে ১০ বছরের মতো নড়াইলের মিঠাপুরের একটা চেম্বারে বসতেন তিনি। প্রচুর রোগীর ভিড় হতো সেখানে। সামান্য ফি’তে ভালো পরামর্শ পাওয়ার কথা চিন্তা করতেই এলাকার মানুষের একটাই অবলম্বন ওমর ডাক্তার নামটা। ১০ বছর পর ডাক্তার ওমর ফারুক বুঝতে পারলেন চিকিৎসা নামক মহান পেশার যথাযথ দায়িত্ব তিনি পালন করতে পারছেন না। নিজের এলাকা থেকে চেম্বার দূরে হওয়ায় এলাকার মানুষেরা সময়মতো চিকিৎসা নিতে পারছেন না এবং ইচ্ছা থাকলেও নিজে এলাকায় সময় দিতে পারছেন না। কেননা সারাক্ষণ চেম্বারে রোগীর আনাগোনা থাকেই। সংসারের একমাত্র ইনকামওয়ালা ওমর ফারুক মন স্থির করলেন ইনকাম যাই হোক না কেন দায়িত্বে অবহেলা করা যাবে না। তাহলে এলাকার মানুষকে ঠকানো হবে। এরপর চেম্বার ছাড়লেন এবং এলাকায় এসে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চিকিৎসা দিতে শুরু করলেন। বিভিন্ন সময় তাকে আমি দেখেছি হেঁটে হেঁটে যাচ্ছেন তো যাচ্ছেন। প্রচুর চাহিদা তার। মানুষের মুখে তার সুনাম ও সততার গল্প প্রচলিত রয়েছে। বেশ কয়েক দিন ধরেই তাকে নিয়ে লিখতে চাইছিলাম। তাই ডাক্তারের সাথে সময় কাটালাম। তার সহজ সরল মানসিকতার এক মনোমুগ্ধকর আচরণে আমি মুগ্ধ হলাম। জীবনযাপনে নেই বিলাসিতা, নেই কোনো জাঁকজমকতা। সাদামাটা জীবনধারার মানুষ। জীবনের ইচ্ছাগুলোও একদম ত্যাগী মানুষেনর মতো। তার একটা কথা বেশ ভালো লাগার। বারবার বলছিলেন ইংরেজি একটা প্রবাদ। তার অর্থÑ ‘একজন ডাক্তারের কাজ রোগ চেনা এবং তার পরই সে রোগের চিকিৎসা দেয়া।’ তার সাথে কথাবার্তার একপর্যায়ে একটি রোগীর ডাক এলো। বাড়িতে যেতে হবে। এটাই আমি মনে মনে চাচ্ছিলাম। রওনা হলাম তার পিছে পিছে। ডাকতে আশা লোকটা বারবার সাইকেলে উঠতে বললেও তিনি উঠলেন না। হেঁটেই গেলেই পাশের এক গ্রামে। রোগীকে অ্যাপেনডিক্স অপারেশন করানো হয়েছিল চলতি মাসেই। কিন্তু তলপেটের জ্বালাপোড়া কোনোভাবেই যাচ্ছে না। নড়াইলের এক ক্লিনিকের ডাক্তার এই অপারেশনের কাজটা করেছেন এবং ১৫ দিনের ওষুধ ধরিয়ে বাড়ি পাঠিয়েছেন। কিন্তু রোগীর জ্বালাযন্ত্রণা ও মনের সন্দেহ দূর করতে পরামর্শ নেয়ার জন্য ডাক্তার ওমর ফারুককে ডেকেছেন। সব কাগজপত্র বের করে দেখালেন তাকে। রিপোর্টগুলো ইংরেজিতে পড়ে বাংলা অনুবাদ করে দিলেন। একজন পল্লী চিকিৎসকের রিপোর্ট পড়ার ও বোঝার সক্ষমতা এমন হতে পারে আগে কখনো ভাবতেই পারিনি। রিপোর্ট পড়া শেষে বোঝা গেল রিপোর্টে অ্যাপেনডিক্সের কোনো কথাই উল্লেখ নেই। রিপোর্টে এসেছে জরায়ুতে সমস্যা। অথচ ডাক্তার করলেন অ্যাপেনডিক্স অপারেশন। ডাক্তার ওমর ফারুক নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বললেন আবার সেই ডাক্তারের কাছে যেতে এবং ফের পরামর্শ নেয়ার জন্য। এত সুন্দরভাবে বুঝিয়ে দিলেন পুরা ঘটনাটা না দেখলে বুঝানো মুশকিল। এরপর ফের আবার গল্পে ফিরলাম তার সাথে। দেখা যায় কোনো রকম ডাক্তারি টাইটেল নামের আগে বসতেই কিছু মানুষ বিভিন্ন ফার্মেসিতে বসেন। চেম্বার খুলে বসে থাকেন বাজারে। কিন্তু আপনার এত নাম ও চাহিদা থাকা সত্ত্বেও আপনি কেন কোনো ফার্মেসিতে বসেন না? তিনি অত্যন্ত বিচক্ষণ একটা উত্তর দিলেনÑ বাজারের অনেক ফার্মেসি থেকেই প্রস্তাব এসেছিল আমার কাছ থেকে কিন্তু ওটা ভালো লাগেনি। কেননা একটি ফার্মেসিতে বসলে রোগীকে চিকিৎসা দেয়ার সময় ওই ফার্মেসিতে থাকা ওষুধের মধ্যেই রোগীর চিকিৎসা খুঁজতে হয়। কিন্তু ওটা আমাকে দিয়ে সম্ভব নয়। ওটা করলে ডাক্তারি সত্তার মরণ হয়। কেননা চিকিৎসাটা কোনো ধরাবাঁধা রুটিনের বিষয় নয়। যে রোগের ওষুধ যেটা সেটাই দিতে হয়। আর একটা ফার্মেসিতে বসে তার প্রেসক্রাইব করলে যদি সেই ওষুধ ওই ফার্মেসিতে না থাকে তাহলে ফার্মেসি মালিক অসন্তুষ্ট হন। এজন্যই ফার্মেসিতে বসাটা আমার বিবেকের প্রশ্ন। জানতে চাইলাম, কাকা, হেঁটে সর্বোচ্চ কত দূরে রোগী দেখতে গেছেন? কাকা বললেন, ২৬ কিলোমিটার। আশা যাওয়া ৫২ কিলোমিটার দূরের একটা রোগী ছিল। সপ্তাহে একবার যেতেই হতো। এভাবে দুই মাস চিকিৎসা করার পর রোগীটা ভালো হলো। এরপর ওখানে আমার অনেক রোগী হলো।

 


আরো সংবাদ



premium cement