২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

দারোয়ান

চারাগল্প
-

একুশে ফেব্রুয়ারির সকালে আমার বন্ধুরা যখন ওদের বাবাকে নিয়ে শহীদ মিনারে ফুল দিতে আসে, তখন আমারও যে বাবাকে বড় মনে পড়ে। বাবা ঢাকা শহরে থাকেন। চাকরি করেন বড় অফিসে। একুশে ফেব্রুয়ারি সরকারি ছুটি থাকার পরও বাবা গ্রামে আসেন না। ছুটি মিললেও শহরে কী কী কাজে নাকি ব্যস্ত থাকেন। দুই-তিন মাস পরপর আয়োজন করে বাড়ি আসেন। আমার জন্য নতুন জামা, জুতা, চকলেট আনতে ভুল করেন না। মায়ের জন্য তাঁতের শাড়ি। শাড়ি পেয়েও মা আপত্তির সুরে বলেন, ‘পাশের বাড়ির শানু ভাবীর স্বামী প্রতি বৃহস্পতিবার বাড়ি আসেন। আপনি আসতে পারেন না?’ বাবা জবাব দেন, ‘আমার যে অফিসে মস্ত কাজ বউ।’ মা অভিমান করেন। বাবা সেই অভিমান ভাঙান। আমি বাবার মোবাইল ধরি। মোবাইলে তার কত ছবি। একটা ছবিতে আমার চোখ আটকে যায়। বাবা শহীদ মিনারের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলেছেন। বাবাকে বলি, ‘পেছনে ওটা শহীদ মিনার না?’ বাবা জবাব দেন, ‘হ্যাঁ বাপ, অফিসের আমরা সবাই বসের সাথে শহীদ মিনার দেখতে গেলাম সেদিন।’
এটা সেই ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার, বইতে এই শহীদ মিনারের গল্প পড়েছি। আমার খুব ইচ্ছে হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে কোনো এক একুশে ফেব্রুয়ারিতে ফুলের মালা নিয়ে যাই।
২.
আজ ফেব্রুয়ারির ২০ তারিখ। ভোরের ট্রেনে চেপে বসলাম ঢাকার উদ্দেশে। বিকালে কমলাপুরে এসে ট্রেন থামে। বাবাকে আগে জানাইনি যে আমি তার কাছে এসেছি। কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে বের হয়ে বিশাল এক ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এটা কী বাবার অফিস! বাবা কী এখানেই চাকরি করেন! বাবাকে ফোন দিলাম। বাবা বিশ্বাসই করতে চাইছেন না আমি সত্যি সত্যি ঢাকায় এসেছি। এই চমকটা দেয়ার জন্যই আসার আগে তাকে জানাইনি।
বাবা কোথায় থাকেন, সেই ঠিকানা বলে দিলেন। আমি রিকশায় চেপে বসে সেই ঠিকানায় যাত্রা শুরু করি। আজিমপুরের ছয়তলা এক বাড়ির সামনে এসে রিকশা থামে। সেই ছয়তলা বাড়ির গেট খুলে যে মানুষটি আমাকে দেখে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেলেন, তিনি বাবা। বাবা এই অভিজাত বাড়িতে থাকেন, আমার বিশ্বাসই হচ্ছে না।
আমাকে গেটের ভেতর নিয়ে গেলেন বাবা। বললাম, ‘কয়তলায় থাকেন আপনি?’ বাবা হেসে বললেন, ‘আমি সিঁড়ির নিচের রুমে থাকি বাপ।’
সিঁড়ির নিচের ছোট্ট একটি রুমে বাবা নিয়ে গেলেন আমাকে। জীর্ণ রুমটি। একটি খাট আর টেবিল ছাড়া কিছুই নেই। বাবা আমাকে খাটে বসিয়ে দিয়ে বললেন, ‘কী খাবি বাপ বল! না বলে এভাবে হুট করে ঢাকায় চলে এলি কেন?’ ম্লান হেসে বললাম, ‘কাল একুশে ফেব্রুয়ারি। শহীদ মিনারে যাবো ফুল নিয়ে।’ বাবা কিছু বলতে যাবেন, তখনই গেটের বাইরে থেকে প্রাইভেটকারের হর্ন বাজল। বাবা ছুটে গিয়ে গেট খুলে দিলেন। প্রাইভেটকারটি ভেতরে ঢোকার পর বাবা আবার গেট লাগিয়ে দিয়ে আমার কাছে এলেন।
রাত ৯টা। দোতলা থেকে একজন বুয়া বাবার জন্য রাতের খাবার নিয়ে এসে আমাকে দেখে বাবাকে বলল, ‘এই ছেলে কে গো, কত্ত সুন্দর দেখতে।’ বাবা বললেন, ‘ও আমার পোলা। রঞ্জু নাম। মেম সাহেবাকে বলে দিয়েন গ্রাম থেকে আজ আমার পোলা এসেছে।’
বাবা তার রাতের খাবার দু’ভাগ করে এক ভাগ আমাকে খাওয়ালেন। ছোট্ট সেই রুমে বাবার সাথে শুয়ে পড়লাম। রাতে শুয়ে শুয়ে বাবা আমাকে তার এক গোপন গল্প শোনালেন। বাবা আসলে এই শহরের কোনো এক বড় অফিসে চাকরি করেন না। তিনি এই অভিজাত বাড়ির সামান্য একজন দারোয়ান। অথচ আমি মা আর আমাদের পুরো বংশ জানে বাবা ঢাকা শহরের বড় অফিসে চাকরি করেন। যখন জানলাম আমি সামান্য এক দারোয়ানের ছেলে, ব্যথায় বুকটা টনটন করে উঠল। রাত ১২টা বাজার পরপর শহরের মোড়ে মোড়ে মাইকে বেজে উঠল একুশের গান। কাল একুশে ফেব্রুয়ারি। শহীদ মিনারে সবাই ফুল নিয়ে যাবে।
৩.
ভোরবেলা। আজ একুশে ফেব্রুয়ারি। খুব ভোরে বাবা ঘুম থেকে জেগে উঠে আমাকেও জাগিয়ে তুললেন। একটু পর বাড়িওয়ালার দুই ছেলে শাকিল আর রায়হানকে নিয়ে বাবা তাদের প্রাইভেটকারে করে শহীদ মিনারে নিয়ে যাবেন ভাষাসৈনিকদের শ্রদ্ধা জানাতে।
শাকিল আর রায়হান কালো পাঞ্জাবি পরে নিচে নেমে এসে বাবাকে বলল, ‘দারোয়ান চাচ্চু, আমাদের শহীদ মিনারে নিয়ে চলো।’ বাবা হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ বাবারা, তোমাদের জন্যই অপেক্ষা করছি।’
শাকিল আর রায়হান আমার পরিচয় জেনে পরম আনন্দে আমাকে বুকে টেনে নিয়ে বলল, ‘কী নাম তোমার? কখন এসেছ? চলো, তুমিও আমাদের সাথে শহীদ মিনারে যাবে।’
বাবা প্রাইভেটকার চালাচ্ছেন। পেছনে বসে আছি আমি শাকিল আর রায়হান। ওদের বাড়ির দারোয়ানের ছেলে জেনেও ওরা আমাকে বড় আপন করে নিলো। গাড়ি এসে থামল ঢাকা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে। হাজার হাজার মানুষ চারদিকে। টিভি চ্যানেলের লোকেরা এসেছে। মাইকে বাজছে চেনা সুরÑ আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো...
বাবা ফুলের ডালি কিনে আনলেন। আমি, শাকিল, রায়হান আর বাবা মিলে খালি পায়ে শহীদ মিনারে উঠে ফুল দিলাম। এক নতুন অভিজ্ঞতা হলো আমার।
৪.
্রআজ ২২ তারিখ। সকাল বেলা। এখনই আমি গ্রামে চলে যাবো। বাবা আমাকে এগিয়ে দিতে সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে এসেছেন। বাসে বসে আছি আমি। কিছুক্ষণ পর বাস ছাড়বে। বাবা আমাকে ফিসফিস করে বললেন, ‘বাপ, বাড়ি গিয়ে তোর মাকে ভুলেও জানতে দিস না যে আমি এই শহরের কোনো এক বাড়ির দারোয়ান। বলবি আমি বড় অফিসে চাকরি করি। কথা দে।’
বাবাকে কথা দিতেই আমার চোখ ভিজে এলো। ওই মুহূর্তে মনে হলো আমার বাবা হলেন এই দুনিয়ার সব থেকে ভালো মানুষটি।
ড্রাইভার বাস ছেড়ে দিলেন। বাবা নেমে গেলেন বাস থেকে। বাসের জানালা দিয়ে আমি বাবাকে দেখছি। বাবা আমাকে টাটা দিচ্ছেন আর জোর গলায় বলছেন, ‘পথে অচেনা কেউ কিছু দিলে খাবি না বাপ। দুনিয়াতে বদলোকের অভাব নেইরে।’ টার্মিনাল পার হয়ে বাসের গতি বাড়ছে। সেই সাথে বাড়ছে আমার বোবা কান্নাও। জানালা দিয়ে মাথা বের করে দূরের পথের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা আমার দারোয়ান বাবাকে দেখি। বাবার পাশে দাঁড়িয়ে একটি কুকুর ঘেউ ঘেউ করে কেন ডাকছে কে জানে!
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী


আরো সংবাদ



premium cement
অবন্তিকার আত্মহত্যা : জবির সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলামের জামিন আবারো নামঞ্জুর পাথরঘাটায় বদর দিবস পালনে দেড় হাজার মানুষের ইফতারি আদমদীঘিতে ৭২ হাজার টাকার জাল নোটসহ যুবক গ্রেফতার সকলকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান মির্জা ফখরুলের জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : মন্ত্রী গাজীপুরে গাঁজার বড় চালানসহ আটক ২ দুই ঘণ্টায় বিক্রি হয়ে গেল ২৫০০ তরমুজ ড. ইউনূসের ইউনেস্কো পুরস্কার নিয়ে যা বললেন তার আইনজীবী একনেকে ৮৪২৫ কোটি টাকার ১১ প্রকল্প অনুমোদন সান্তাহারে ট্রাকের চাকায় পিষ্ট হয়ে যুবক নিহত জলবায়ু সহনশীল মৎস্যচাষ প্রযুক্তি উদ্ভাবনে পদক্ষেপ নেয়া হবে : আব্দুর রহমান

সকল