২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

ভাষা আন্দোলন ও মানিকগঞ্জ

মানিকগঞ্জের প্রথম শহীদ মিনার। যে শহীদ মিনারটি টিকে আছে আজও : মিরান উদ্দিন ; কমরেড আবদুল হাকিম মাস্টার; ওয়াজ উদ্দিন মাস্টার -

‘ভাষা আন্দোলন’ বাংলা ও বাঙালির এক ঐতিহাসিক পটভূমি। মাতৃভাষা বাংলার দাবিতে দেশব্যাপী যে আন্দোলন সংগ্রাম গড়ে ওঠে, তার প্রভাব রাজাধানী ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকার অদূরে মহকুমা শহর মানিকগঞ্জে মাতৃভাষা বাংলার দাবির ঢেউ একটু বেশিই ওঠে। গঠিত হয় মাতৃভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদ। ভাষার লড়াই ছিল বাংলা এবং বাঙালির প্রথম সার্থক লড়াই। আর এই লড়াই ও বিজয়ের এক মহানায়ক মানিকগঞ্জের শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ। সিংগাইর উপজেলার বলধরা ইউনিয়নের প্রাচীন গ্রাম পারিলে ১৯২৬ সালের ৩০ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন এই মহামানব। শহীদ রফিকই সম্ভবত পৃথিবীতে ভাষার জন্য প্রথম শহীদের মর্যাদা লাভ করেন।
১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ওই সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে আন্দোলন চলতে থাকে। মূলত মানিকগঞ্জ জেলার ঘিওর থানার তেরশ্রীতে এই আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটে। তেরশ্রী কেএন ইনস্টিটিউশনের সহকারী প্রধান শিক্ষক প্রমথ নাথ নন্দী এই আন্দোলন সংগঠিত করতে থাকেন। প্রমথ নাথ নন্দীর সাথে যুক্ত হন একই বিদ্যালয়ের ক্রীড়াবিষয়ক শিক্ষক আফছার উদ্দিন আহম্মেদ। এদের দু’জনের প্রেরণায় আন্দোলন ক্রমেই বেগবান হতে থাকে। মানিকগঞ্জে মাতৃভাষা আন্দোলন সংগ্রাম পরিষদের ব্যানারে ধীরে ধীরে যুক্ত হতে থাকে প্রগতিশীল ছাত্র ও ব্যক্তিরা। সে সময়ে মানিকগঞ্জ জেলাকেন্দ্রিক ভাষা আন্দোলনের ব্যানারে যারা অংশগ্রহণ করে তারা হলেনÑ তেরশ্রী কেএন ইনস্টিটিউশনের সহকারী প্রধান শিক্ষক প্রমথ নাথ নন্দী, ক্রীড়া শিক্ষক আফছার উদ্দিন আহম্মেদ, কলেজ শিক্ষার্থী প্রমথ নাথ সরকার, ডা. মোবারক আলী, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ডা: আবদুুল সালাম। তেরশ্রী কেএন ইনস্টিটিউশনের ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী আবদুুল হাকিম, আবদুর রহমান ঠাকুর, মনিন্দ্র নাথ সরকার, সিরাজ উদ্দিন মৃধা, নবম শ্রেণীর শিক্ষার্থী মিরান উদ্দিন, মো: ওয়াজ উদ্দিন, মো: রেহাজ উদ্দিন প্রমুখ। মানিকগঞ্জ সদরের যারা ছিলেন তারা হলেনÑ ডা: সামসুর রহমান, আনোয়ার আলী চৌধুরী, ওয়ারেশ উদ্দিন পাশা, জাফর আলম চৌধুরী, খন্দকার দেলোয়ার হোসেন প্রমুখ। উল্লিখিত আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে তৎকালীন সরকার হুলিয়া জারি করে।
সব আন্দোলনকারী গ্রেফতার এড়িয়ে গোপনে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু তার পরও পাকিস্তান প্রশাসক কড়া নজরদারিতে রাখে আন্দোলনকারীদের। আর এরই বহিঃপ্রকাশ ঘটে হঠাৎ করে তেরশ্রী কেএন ইনস্টিটিউশনের চার শিক্ষার্থীকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে। ১৯৪৮ সাল থেকে সূচিত ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালে তীব্রতা পায়। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার ছাত্র-জনতার মিছিলে পুলিশ কোনো সতর্কাবস্থা ঘোষণা ছাড়াই গুলিবর্ষণ করলে মানিকগঞ্জের রফিকসহ সালাম, বরকত, জব্বার আরো নাম না জানা আন্দোলনকারী শহীদ হন। শহীদ রফিক উদ্দিনের মাথার পেছনে গুলি লাগে এবং মাথার পেছনের প্রায় সম্পূর্ণ অংশ উড়ে যায়। শহীদ রফিক সিংগাইর উপজেলার বায়রা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিক পাস করেন এবং মানিকগঞ্জ দেবেন্দ্র কলেজ থেকে আইকম পাস করে ঢাকার জগন্নাথ কলেজে স্নাতক শ্রেণীতে ভর্তি হন। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মিছিলে মানিকগঞ্জের খন্দকার দেলোয়ার হোসেন, আ: সালাম, মীর আবুর খায়ের (ঘটু) উপস্থিত ছিলেন। খন্দকার দেলোয়ার হোসেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন, আ: সালাম ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্র ছিলেন। ঢাকার মিছিলে গুলিবর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে তীব্র গণজাগরণ গড়ে ওঠে। এরই ধারাবাহিকতায় ঘিওরের তেরশ্রী স্কুলমাঠে, মানিকগঞ্জের দেবেন্দ্র কলেজ মাঠে হাইস্কুলসংলগ্ন স্থানে, সিংগাইরের চারিগ্রামে গণপ্রতিবাদ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মানিকগঞ্জে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে যারা বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন তাদের মধ্যে প্রমথ নন্দী, মুনিন্দ্র নাথ সরকার, অরুণ রায় উকিল, প্রিয়নাথ সরকার, নিখিল রঞ্জন ভট্টাচার্য (দক্ষিণাবাবু), সমবায় পরিদর্শক সৈয়দ আনোয়ার আলী চৌধুরী, ডা: সামসুর রহমান প্রমুখ উল্লেখযোগ্য।
কমরেড প্রমথ নন্দী বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানালে ১৯৪৮ সালে তেরশ্রীতে এক ছাত্র-জনতার সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সমাবেশ শেষে ছাত্র-জনতার এক বিরাট মিছিল ঘিওরসহ বিভিন্ন স্থান প্রদক্ষিণ করে। ১৯৪৯ সালের জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানি পুলিশ প্রশাসন তেরশ্রী কেএন ইনস্টিটিউশন থেকে যাদের ভাষা আন্দোলের দায়ে গ্রেফতার করে তারা হলেনÑ মো: ওয়াজ উদ্দিন, মো: রেহাজ উদ্দিন, ভূপেন্দ্র নাথ দাশ (হাসী), মনিন্দ্র নাথ সরকার। ওই আন্দোলনে ডা: সামসুর রহমানের ভগ্নিপতি নাম না জানা আরো একজন অংশগ্রহণকারী ছিলেন।
‘১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির পর ভাষা শহীদদের স্মরণে মানিকগঞ্জের প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ঢাকার অনুরূপ শহীদ মিনার তৈরি করা হয়। কিন্তু সরকারি কর্তৃপক্ষ পুলিশের সহায়তায় সব শহীদ মিনার ভেঙে ফেলে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণে কর্তৃপক্ষের বাধার কারণে ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতারা অ্যাডভোকেট আ: লতিফ বিশ্বাসের বাসার সামনে শহীদ মিনার তৈরি করে। ১৯৫৪ সাল থেকে অদ্যাবধি ওই শহীদ মিনারটি মানিকগঞ্জের প্রথম শহীদ মিনার হিসেবে টিকে আছে।
যুক্তফ্রন্ট সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী আবদুল লতিফ বিশ্বাসের সহধর্মিণী উম্মে সাহেরা খাতুন। মানিকগঞ্জ শহরের এসকে গার্লস স্কুলের সামনেই সাহেরা খাতুনের বাড়ি। ছাত্র নেতারা তার বাড়ির সামনের খোলা জায়গায় রাস্তা ঘেঁষে শহীদ মিনার নির্মাণের প্রস্তাবনা সাহেরা খাতুনের কাছে উত্থাপন করেন। সরকারের সেই মুহূর্তের অগ্নিদৃষ্টির কথা সাহেরা খাতুন ভালোই জানতেন। তার পরও কোনো রকম ইতস্তত না করে অনুমতি দিলেন শহীদ মিনার হবে। দিনটি ছিল ২০ ফেব্রুয়ারি। পরদিনই শহীদ দিবস। যে করেই হোক যত ছোটই হোক, শহীদ মিনার হবে। ছাত্র নেতারা বুলেট গতিতে ইট-বালু-সিমেন্ট জোগাড় করে ছোট্ট একটি ইটের স্তম্ভের আকারে শহীদ মিনার তৈরি করলেন সেই দিনের মধ্যেই। মানিকগঞ্জ শহরে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে এ খবর পৌঁছাতে দেরি হয়নি প্রশাসনের কাছে। সে সময়ের এসডিও ছিলেন এ কে দত্ত চৌধুরী। তিনি বিপুল পুলিশ নিয়ে হাজির হলেন শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দেয়ার জন্য। তবে এসবের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুত ছিলেন সাহেরা খাতুন। অসীম সাহসে সেই পুলিশ বাহিনী ও শহীদ মিনারের মাঝখানে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করলেন; তেজোদীপ্ত কণ্ঠে হুঙ্কার দিয়ে বললেন, ‘আমার জায়গায় আমি শহীদ মিনার বানিয়েছি। কার সাহস তা ভাঙে?’ তার এ হুঙ্কার ও যৌক্তিক কথায় থেমে গেলেন এসডিও এবং পুলিশ বাহিনী। তারা আর সাহেরা খাতুনকে অতিক্রম করে শহীদ মিনার ভাঙার সাহস পেলেন না।
মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার তেরশ্রী গ্রামের ভাষাসৈনিক কমরেড আ: হাকিম মাস্টার। বর্তমানে তিনি জীবনমৃত্যুর সন্ধিক্ষণে। ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠকও। কিন্তু তার পরও ভাগ্যে জোটেনি কোনো রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। দারিদ্র্যের সাথে মিতালি করে করছেন মানবেতর জীবনযাপন। ঘিওর উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবদুল আজিজ বলেন, ‘কমরেড আবদুল হাকিম মাস্টারকে অবিলম্বে ভাষাসৈনিক হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য প্রশাসনের সুদৃষ্টি কামনা করছেন।’ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের সময়কার নবম শ্রেণীর সেই টগবগে কিশোর মিরান আজ ৮৬ বছরের এক বৃদ্ধ। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীরটা এখন আর আগের মতো সচল নেই। তবুও স্মৃতি হাতড়ে খুঁজে ফেরেন জীবনের সমৃদ্ধ অতীত। ফেব্রুয়ারি এলেই মনে পড়ে সেই উত্তাল দিনগুলো। মাতৃভাষার জন্য জীবন উৎসর্গ করতে সেদিন এতটুকু দ্বিধা বা ভয় ছিল না তার। বাঙালির মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর সেই আন্দোলনের একজন অংশীদার হিসেবে এখনো গর্ববোধ করেন তিনি। বয়সের ভারে শরীরের বেঁধেছে নানা অসুখ-বিসুখ। স্মৃতিশক্তিও কমে গেছে। কথায় এসেছে জড়তা। সহ-আন্দোলনকারীদের দু-একজন ছাড়া কেউই আর বেঁচে নেই। উদাসী দৃষ্টিতে যেন কিছুটা অপ্রাপ্তির ছায়া। যাদের আন্দোলনের ফসলে আমরা আজ মাতৃভাষা বাংলায় কথা বলি। সেই ভাষাযোদ্ধার জীবনের শেষ চাওয়াÑ রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিটুকু পেলে যেন মরেও শান্তি পাবো।
রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করার আন্দোলনের সাথে যারা সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে মানিকগঞ্জের মরহুম ওয়াজ উদ্দিন মাস্টার অন্যতম। ১৯৩৪ সালের পহেলা মার্চ মানিকগঞ্জের ঘিওর উপজেলার তেরশ্রীর পয়লা গ্রামে বাহার উদ্দিন ও দুলি বেগম দম্পতির ঘরে জন্ম নেন তিনি। তার স্মৃতিচারণ করে তার মেয়ের জামাই শিক্ষক সিরাজুল ইলাম জানান, ভাষা আন্দোলনের জন্য মানিকগঞ্জে কয়েক দিন জেল খাটার পর তাদের পাঠানো হয় ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হওয়ায় তাদের পক্ষে প্রথমে কোনো আইনজীবী পাওয়া যাচ্ছিল না। পরে এমসিএ আইনজীবী ভবেশ নন্দী তাদের জামিনে মুক্তি করিয়ে আনেন। কিন্তু জেল থেকে বেরিয়ে তাদের আন্দোলন থেমে যায়নি। ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়া এই ২১ জন ভাষাসৈনিক ও আন্দোলনের স্থান ঘিওরের তেরশ্রীতে স্মৃতির উদ্দেশ্যে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ভাষা আন্দোলনে মানিকগঞ্জের অবদানের ইতিহাস জানতে পারে।
ভাষাসৈনিক কমরেড আবদুল হাকিম মাস্টারের সাথে আলাপকালে তিনি দুঃখ করে বলেন, ‘ভাষার জন্য আমরা সংগ্রাম করেছি, জেল খেটেছি, জুলুম-অত্যাচার-নির্যাতন সহ্য করে দিনের পর দিন পালিয়ে থেকেছি। এত কিছুর পরও ভাষার প্রতি চলছে চরম অবজ্ঞা।’ তিনি আরো বলেন, ‘২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হওয়ায় বুকটা গর্বে ভরে গেছে। সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে উঠে সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহার বাস্তবায়ন করা হোক।’ এই ভাষাযোদ্ধারও জীবনের শেষ চাওয়াÑ ‘রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতিটুকু পেলে যেন মরেও শান্তি পাবো।’

 


আরো সংবাদ



premium cement