২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৭ বৈশাখ ১৪৩১, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫
`

দুঃখ দিঘির জল চারাগল্প

-

মফস্বলের শেষ গলির পাঁচতলা বিল্ডিংয়ের দোতলায় সাজ বিউটি পার্লার। এই বিউটি পার্লারের কর্ণধার ফারিয়া। একজন দক্ষ বিউটিশিয়ান হিসেবে তার যথেষ্ট চাহিদা আছে। আশপাশের ১০ গ্রামের বউ সাজানো ছাড়াও দূর-দূরান্ত থেকে বিভিন্ন মেয়েরাও সাজতে আসেন। ফারিয়ার দক্ষতা আর মেকআপের কারিশমায় নারীরূপকে করে তোলে অপরূপা। প্রায় প্রতিদিন দু-চারটা বউ সাজানোর খাটুনি সে হাসিমুখে করে দেয়। বিনিময়ে পায় ভালো পেমেন্ট। পার্লারে যেসব মেয়ে রোজ সাজতে আসে, তাদের সাথে ফারিয়ার ভালো সম্পর্ক হয়ে যায়। ফলে অনেক মেয়ে জানতে চায়, ‘আপু, আপনি বিয়ে করবেন কবে?’
বিয়ে! ফারিয়ার কাছে এটি একটি দীর্ঘশ্বাসের প্রশ্ন। বিয়ে সে জীবনে আর করবে না। অথচ একটি সংসারের স্বপ্ন একসময় তারও ছিল। একজন ভালোবাসার মানুষও ছিল তার। সে আশিক, যাকে জীবন দিয়ে ভালোবাসত ফারিয়া। ভার্সিটির ক্লাস ফাঁকি দিয়ে রিকশায় চড়ে দু’জনে শহরের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ঘুরে বেড়াত। আশিকের বুকে মাথা রেখে ফারিয়া দেখত নীলাকাশ। দু’জনে সংসার সাজাবার পরিকল্পনাও করেছিল। কিন্তু সম্বন্ধের বেলায় উভয় পরিবারের বনিবনা হয়নি। আশিকের বাবার প্রথমত ফারিয়াকে পছন্দ হয়নি, দ্বিতীয়ত ফারিয়াদের বংশমর্যাদা আশিকদের মতো উন্নত নয়। ফলে আশিকের বাবা ছলে বলে কৌশলে এই সম্পর্ককে ছিন্ন করেছেন। রক্ষণশীল পরিবারের সন্তান হওয়ার সুবাদে আশিক বাবার ওপর আর কথা বাড়ায়নি। সে সরে আসে ফারিয়ার জীবন থেকে।
জীবন থেকে প্রেম অধ্যায়ের ইতি টেনে আশিক স্বাভাবিক জীবনযাপন করলেও দুঃখ নামক এক যন্ত্রণার দিঘির জলে তলিয়ে যেতে যেতে ফারিয়া বুঝতে পারে সে তার জীবনের সাথে আর কাউকে জড়াতে পারবে না। তাই বাকিটা জীবন একা থাকার এক কঠিন পদক্ষেপ নেয়।
তারপর বিউটি পার্লার খুলে নিজেকে একজন দক্ষ বিউটিশিয়ান হিসেবে তরুণী মহলে দারুণ প্রশংসা কুড়ায়।
২.
আজ যে মেয়েটা বউ সাজতে এসেছে, তার নাম তামান্না। ফারিয়া খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে তামান্নাকে দেখছে। বেশ মায়াবতী মেয়েটি। চেহারায় দারুণ আকর্ষণ আছে। ফারিয়া খেয়াল করেছে তামান্না মেয়েটাকে বড্ড খুশি খুশি দেখাচ্ছে। এখানে যারা বউ সাজতে আসে, সাধারণত তাদের মাঝে এত চঞ্চলতা দেখা যায় না, যতটা দেখা যাচ্ছে তামান্নার মাঝে। প্রতিদিন অনেক মেয়ে আসে, যাদের বিয়েতে মত না থাকার পরও পরিবারের চাপাচাপিতে তারা বিয়েতে রাজি হয় এবং জোর করে তাদের পার্লারে পাঠানো হয়। মন মরা থাকে তাদের। তামান্না তাদের মতো নয়।
তামান্নাকে বউ সাজাতে সাজাতে ফারিয়ার সাথে ভাব হয়ে গেল। দু’জনের মুখরোচক কথাও জমে উঠেছে খুব। ফারিয়া লক্ষ করল সুন্দর করে কথা বলাতেও মেয়েটা বেশ পটু।
পুরোপুরি বউ সাজাবার পর আয়নায় নিজেকে দেখে শুধু তামান্না নয়, ফারিয়াও মুগ্ধ। সত্যি বধূবেশে তামান্নাকে দারুণ লাগছে। বিশেষভাবে ধন্যবাদ জানাল তামান্না ফারিয়াকে। ফারিয়া মিষ্টি হেসে বলে, ‘যার জন্য এত সুন্দর করে সেজেছ, সেই মানুষটি বাসর ঘরে তোমাকে দেখে পাগল হয়ে যাবে।’ তামান্না লজ্জায় রাঙা হলো। ফারিয়া বলল, ‘মোবাইলে তোমার হবু বরের ছবি আছে না! দেখাও। দেখি সে কে ভাগ্যবান, তোমার মতো ডানাকাটা পরী পেয়েছে!’ তামান্না মোবাইল বের করে তার হবু বরের ছবি ফারিয়াকে দেখায়।
ফারিয়ার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। তামান্না তার স্বামীর পরিচয়ে মোবাইলে এ কার ছবি দেখাচ্ছে! এ যে স্বয়ং আশিকের ছবি। আশিকের সাথে তামান্নার বিয়ে!
ফারিয়া তামান্নার দিকে তাকায়। তামান্না হাসছে আর আহলাদি গলায় বলছে, ‘আপু, ওর নাম আশিক। খুবই ভালো আর স্মার্ট। ব্যাংকে জব করে। আমাদের জন্য দোয়া করবেন।’ ফারিয়ার পারিশ্রামিক দিয়ে বধূবেশের তামান্না চলে গেল।
বারান্দায় এসে অঘোরে কাঁদছে ফারিয়া। এ এক অদ্ভুত পরিস্থিতির আজ সে সাক্ষী হয়েছে। যার জন্য তার বউ সাজা হলো না, আজ তার বউকে সে সাজিয়ে দিলো। চোখের পানি টপটপ করে পড়ছে শুধু। যেন চোখের ভেতরে দুঃখ দিঘির জলেরা আজ বেদনা হয়ে উপচে পড়ছে।
আমিশাপাড়া , নোয়াখালী


আরো সংবাদ



premium cement