২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০, ১৭ রমজান ১৪৪৫
`

আগুন পোহানো শীত

চারাগল্প
-

সকাল থেকে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। এখন মধ্য দুপুর গড়িয়েছে। বাতাস কমেনি। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছে না। ঘরে বসে বই পড়ছি। বাবা ডেকে পাঠালেন। বললেন, তার আত্মীয়ের বিয়েতে যেতে হবে। কাচুমাচু করলাম। বাইরে যে শীত! অগত্যা যেতে হলো। হাড়কাঁপানো বাতাসের ভেতর দিয়ে আধ মাইল হেঁটে বরের বাড়ি গেলাম। আমার পৃথিবীতে হালকা বৃষ্টির মতো শুভ্র শিশির পড়ছে। মশারির জালের মতো ছেঁড়া ছেঁড়া কুয়াশা উড়ছে। রাস্তায় তেমন মানুষ চোখে পড়েনি। দু-একজনকে দেখলাম, সারা শরীরে কাপড় মোড়ানো। চেনার উপায় নেই। রহস্যময়ী মানুষের মতো লাগে।
বরবাড়ি থেকে আরো আধ মাইল হেঁটে নৌকায় চড়লাম। নৌকাবিহীন কোনো গতি নেই আমাদের গ্রামের মানুষের। নৌকার গতির সঙ্গে বাতাসের তীব্রতা বাড়ছে। কোট, পাঞ্জাবি ভেদ করে হৃদয়কে পর্যন্ত কাঁপিয়ে তুলছে হিমেল হাওয়া। বরফের মতো ঠাণ্ডা হয়ে আছে হাত পা। নিজেকে অসাড় লাগছে। ঘণ্টাখানেক চলার পর নৌকা ঘাটে ভিড়ল। তখন আসরের আজান পড়ছে। কনের বাড়ি যেতে আবারো হাঁটলাম। হেঁটে হেঁটে ক্লান্ত প্রাণ এক।
খাবার শেষ করতে সন্ধ্যা হলো। বাইরে বেশ কুয়াশা পড়ছে। কুহেলিকার ভেতর দিয়ে ভিন্ন নৌকায় গ্রামের দিকে চললাম। কিছুটা পথ চলার পর, চোখের সামনে ভাসে কাতলচর। আহ্ কাতলচর! আমার স্মৃতির শহর। সেই কিশোর বেলায়, ১০ বছর আগে- কাতলচর ঘাটে নেমে মায়ের আঙুল ধরে নানিবাড়ি যেতাম। মাঠ, ঘাট, ক্ষেত, খামার পেরিয়ে, গ্রামের পর গ্রাম ছাড়িয়ে নানিবাড়ি পৌঁছতাম। নানি হরেকরকম বাহারি স্বাদের খাবার দিতেন। গেল বছর নানি মারা গেলেন। তবে কাতলচরের গ্রামীণ কৃষি পথ পেরিয়ে নানিবাড়ি যাওয়া হয় না কত বছর হলো! কাতলচর পেছনে ফেলে আসি। গলে পড়া অবিরাম কুজ্ঝটিকার শুভ্রতার ভেতর স্মৃতিরা ভেঙে বিচূর্ণ আয়নার মতো পড়ে থাকে।
সন্ধ্যা গভীর করে ঘাটে নৌকা ভিড়ল। ভাড়া চকিয়ে বাড়ির পথে পা বাড়ালাম। পথের পাশে আগুন জ্বলছে। আগুনের আশপাশে গোল করে দাঁড়িয়ে আছে কিশোর দল। গেলাম সেখানে। বেশ ছেলেপেলে। আগুন পোহাচ্ছে। হিমায়িত শরীরে আগুনের গরম পরশ দেহে উষ্ণতা ছড়ায়। কাগজ, পেপার, পলিথিন, শুকনো খড়, বন পোড়াচ্ছে। আগুনে প্রচণ্ড তেজ। অল্পতে শরীর চাঙ্গা হয়ে উঠল। ওদের সাথে গল্প জুড়ে বসি। আবিরের বয়স ৯ বছর। ঢাকা উত্তরার এক স্কুলে ক্লাস টুতে পড়ে। আগামীকাল শুক্রবার। গতকাল গ্রামের বাড়ি বেড়াতে এসেছে। বাসার পেপার পোড়াতে এনেছে। বলল, ‘মা দেখলে বকবেন। লুকিয়ে এসেছি। ঠাণ্ডার রাতে আগুন পোহাতে আরাম লাগে। বন্ধুদের সাথে ভালো লাগে।’ মনোয়ার এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে। নরসিংদী শহরে পড়াশোনা করে। বলল, বাসায় বোরিং লাগছে। সারা দিন বের হইনি। রাজিব ডেকে আনল। আগুনের তাপে বেশ লাগছে। আশপাশে কোনো শীত নেই।’
‘আপনেরা কোট প্যান্ট লাগাইছেন। আমডা লাগাইনাই। শীত লাগে না। হেতে দৌড়ে পালাইছে। আমরা শীতেরে ডরাই না। আগুন জালাইয়া শীতেরা ভাগাইয়া দিছি।’ বলল জেলে নাইম। তারা হেসে খেলে শীত পোহাচ্ছে। কোনো উদ্বেগ নেই। তাড়া নেই। অভিযোগ অনুযোগ নেই। শুধু হৈ হুল্লোড়ে মেতে আছে তাদের পৃথিবী।
মনে পড়ে, ২০০৮ সাল। তখন এই গ্রামে পড়ি। মাঘের প্রচণ্ড শীত নেমেছিল সেবার। মাকড়সার জালের মতো কুয়াশায় ছেয়ে থাকত গ্রাম। কাছের লোককেই চেনা যেত না! নদী মাঠ স্কুল কুয়াশার ভেতর ঢুকে যেত। ধূমপানে যেমন মুখ দিয়ে ধোঁয়া বের হয় তেমনি আমাদের মুখ দিয়ে সফেদ পবিত্র ধোঁয়া বের হতো। সে সময় আছিয়া নামের এক মাঝ বয়সী মহিলা প্রায়ই হারিয়ে যেত। তার আত্মীয়রা খুঁজে পেরাশান হতেন। তখন আমরা বন্ধুরা মিলে, সূর্য ওঠার অনেক আগেই বাড়ির রাস্তা পার হয়ে মাঠে যেতাম। রাতে কুড়ানো পাতা, কাগজ, পলিথিন দিয়ে আগুন ধরাতাম। শীত দৌড়ে পালিয়ে যেত। আনন্দে মেতে উঠতাম। দু-একজন কাঠি দিয়ে কাগজ দিতেন, আগুন নাড়াচাড়া করতেন। আগুন পোহানো শেষে একযোগে দৌড়ে গ্রামের পুবে যেতাম। কুয়াশায় হারিয়ে যেতাম। ভয়ে ভয়ে গলা ছাড়তাম। ডাকতাম পরস্পরকে। আমাদের আওয়াজ কুয়াশার গা ভেদ করে কোথায় যে হারিয়ে যেত, আজো জানা হয়নি।
একদিন আনোয়ার কাকা কাঠি দিয়ে পলিথিনের আগুন নাড়ছে, হঠাৎ আগুনের ফুলকি এসে পড়ে শামীমের হাতে। শামীমের কী কান্না মাইরে! সাথে সাথে ঠুসা উঠে যায়। আমরা ভয় পেয়ে গেলাম। শামীমের আগুনে পোড়ার খবর বাড়িঘরে চাউর হলো। আনোয়ার আর শামীমের পরিবারে ঝগড়া বেধে গেল। মা ভাইকে পাঠালেন। ভয়ে ভয়ে গেলাম। মা বকেননি। কিছু কথা শুনিয়ে দিলেন। বাবা তখন প্রবাস থাকতেন। এরপর আর কোনো দিন আগুন পোহাতে সাহস করেনি।

 


আরো সংবাদ



premium cement
মতলব উত্তরে পানিতে ডুবে ভাই-বোনের মৃত্যু প্রাথমিকে শিক্ষক নিয়োগের শেষ ধাপের পরীক্ষা শুক্রবার লম্বা ঈদের ছুটিতে কতজন ঢাকা ছাড়তে চান, কতজন পারবেন? সোনাহাট স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করলেন ভুটানের রাজা জাতীয় দলে যোগ দিয়েছেন সাকিব, বললেন কোনো চাওয়া-পাওয়া নেই কারওয়ান বাজার থেকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে ডিএনসিসির আঞ্চলিক কার্যালয় এলডিসি থেকে উত্তরণের পর সর্বোচ্চ সুবিধা পেতে কার্যকর পদক্ষেপ নিন : প্রধানমন্ত্রী নারায়ণগঞ্জ জেলার শ্রেষ্ঠ ওসি আহসান উল্লাহ ‘ট্রি অব পিস’ পুরস্কার বিষয়ে ইউনূস সেন্টারের বিবৃতি আনোয়ারায় বর্তমান স্বামীর হাতে সাবেক স্বামী খুন, গ্রেফতার ৩ ফতুল্লা প্রেস ক্লাবের ইফতার মাহফিল অনুষ্ঠিত

সকল