২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

একদিন সূর্যের দিন

চারাগল্প
-

সমাহার প্রকাশনীর কর্ণধার আমজাদ হোসেন সকাল ১০টায় আমাকে কল দিয়ে বললেন, ‘আজ তোমাকে বইমেলায় থাকতেই হবে। তোমার ‘স্বপ্নের মানুষ’ বইটি এবারো আমাদের বেস্ট সেলার। রোজ পাঠকেরা বইটি কিনতে এসে তোমার তালাশ করে। অটোগ্রাফ আর ছবি তুলতে চায়। আজ এসো কিন্তু।’ প্রকাশক সাহেবকে কথা দিলাম বিকেলে বইমেলায় থাকব।
এ দেশের মানুষ আমাকে একজন নন্দিত কথা সাহিত্যিক হিসেবে জানে। লেখালেখিকে ভালোবাসলেও এটা একদিন আমার জীবিকা হিসেবে দাঁড়াবে, ভাবিনি। খুব ছোটবেলা থেকে গল্প কবিতার প্রতি আমার ঝোঁক ছিল অগাধ। পাশের বাড়ির মুনমুন আপার কাছ থেকে উপন্যাস আনতাম পড়তে। পড়ে আবার ফেরত দিতাম। একদিন মুনমুন আপা মুখের ওপর বলে দিলেন, ‘আর বই নিতে আসবি না। কিনে পড়তে পারিস না?’
বই কিনে পড়ার মতো অবস্থা তখন আমাদের ছিল না। আমি বড় হয়েছি অভাবের সাথে যুদ্ধ করে। বাবা মুক্তিযুদ্ধে গিয়ে আর ফিরে আসেননি। মা পরের বাড়িতে কাজ করে আমার পড়ালেখার খরচ চালাতেন। কোনো কোনো দিন মায়ের সাথে অনেকের বাড়িতে যেতাম, যেখানে তিনি কাজ করে টাকা পেতেন আর দু’বেলা ভাত। কোনো কোনো বাড়িতে দেখতাম তাদের বুকশেলফ ভরা গল্পের বই। আমার দারুণ আনন্দ হতো। বুকশেলফ থেকে বই বের করে পড়তাম। ওই বয়স থেকেই আমি কাজী নজরুলের ভক্ত। ‘রিক্তের বেদন’ ওই বয়সেই পড়ে ফেলেছি।
একটা সময় এসে মনে হলো ইচ্ছা করলে আমিও লেখালেখি পারব। হারিকেনের আলোয় বসে রাত জেগে গল্প লিখি। পাঠিয়ে দিই পত্রিকায়। আমাকে অবাক করিয়ে দিয়ে সে গল্প ছাপা হয়। লেখালেখি হয়ে ওঠে আমার নেশা। পত্রিকার পাতায় নিয়মিত আমার গল্প যায়। সেসব গল্পের প্রশংসা করে সারা দেশ থেকে আমার চিঠি আসে। আমি পড়ি আর আনন্দে কাঁদি। একদিন এক প্রকাশনা থেকে প্রকাশকের চিঠি আসে। তিনি পেপারে গল্প পড়ে আমার প্রতিভা দেখেছেন। আমার বই প্রকাশ করতে ইচ্ছার কথা জানিয়ে তিনি চিঠি লেখেন। আমি পাণ্ডুলিপি পাঠাই। বইমেলায় আমার প্রথম বই ‘দুয়ারে দাঁড়িয়ে’ প্রকাশ হয়। আশ্চর্যজনকভাবে সেই বই হিট। এ ঘটনার পর তারা আমার বই টানা কয়েক বছর বইমেলায় বের করেন। সব বই পাঠক ভালোভাবে গ্রহণ করেন। আমি হয়ে যাই জনপ্রিয়। সারা দেশে আমার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। অন্য প্রকাশকেরা ও আমাকে বই করতে প্রস্তাব দেন। আমি সবাইকে পাণ্ডুলিপি দেই। বাড়তে থাকে আমার বইয়ের সংখ্যা। লাখ লাখ টাকা আসে।
এই যে আমার ডুপ্লেক্স আলিশান বাড়ি, লেখালেখির উপার্জনে এই বাড়ি গড়েছি। বাড়ির নাম ‘রহিমা ভিলা’। আমার মায়ের নামে নাম। যাকে একদিন গ্রামের মানুষ ‘কাজের বেটি রহিমা’ ডাকত তাচ্ছিল্যে। আজ সেই কাজের বেটি রহিমার বিচিত্র এক আয়েশি জীবন। মা যখন হুইলচেয়ারে বসে চোখের পাওয়ারফুল চশমার ভেতর থেকে তার পবিত্র দু’টি চোখের বিস্মিত দৃষ্টি আমার লেখা কোনো উপন্যাসের পাতায় রাখেন, তখন গৌরবে আমার বুক ভরে যায়।
সমাহার প্রকাশনীর প্যাভিলিয়নে বসে আছি। আমাকে ঘিরে উৎসুক পাঠকের ঢল। কলমের অটোগ্রাফ আর সেলফির সামনে পোজ দিতে ভালোই লাগছে। কেউ কেউ আবার আমার লেখা ঘিরে তাদের অভিমত জানাচ্ছে। আনন্দ হয়, আমার লেখার নানান বয়সের পাঠক আছেন।
বয়স প্রায় ৫০ এর কাছাকাছি একজন ভদ্রমহিলা আমার দিকে এগিয়ে এলেন। তার হাতে আমার বইÑ স্বপ্নের মানুষ। স্নেহের সুরে অটোগ্রাফ চাইতেই হাসিমুখে লিখে দিলাম। আন্তরিক গলায় বললেন, ‘তোমার লেখা আমাকে জাদুর মতো টানে বাবা! সব বই পড়েছি তোমার। ভীষণ ভক্ত বলতে পার। তোমার আরো সাফল্য কামনা করি।’
শুভ কামনা জানিয়ে ভদ্রমহিলা চলে যাচ্ছেন। তিনি আমাকে চিনতে না পারলেও আমি তাকে চিনেছি। উনি আল্পনা করিম। একসময় আমার মা উনার বাড়ির ছুটা বুয়া ছিলেন। ছোট্ট সেই আমি প্রায়ই সেখানে যেতাম মায়ের সাথে। বইপ্রেমী আল্পনা করিমের প্রচুর বই ছিল। বদমেজাজের আল্পনা করিমের ভয়ে আমি প্রায়ই তার বইয়ের সংগ্রহশালা থেকে গল্পের বই বের করে লুকিয়ে পড়তাম। একদিন ধরা খেলাম। আল্পনা করিম ক্ষিপ্ত গলায় বললেন, ‘কার অনুমতি নিয়ে আমার বই ধরেছিস ফকিন্নির পোলা! তোর মা এই বাড়ির বুয়া। বুয়ার ছেলে হয়ে বই পড়িস! শখ কত! তোরা অশিক্ষিত। লেখাপড়ার কী বুঝবি! আর কোনো দিন আমার বই ধরবি তো চড় মেরে দাঁত সব ফেলে দেবো।’
সেদিন এ ঘটনায় আমি ঘাবড়ে গেলাম, কিন্তু কিছুই বলিনি। শুধু দেখেছি মা আড়াল থেকে মুখ লুকিয়ে কাঁদছেন। জল পড়া চোখে কত করুণই না লেগেছিল আমার সংগ্রামী মাকে।
বই পড়ার অপরাধে একদিন যিনি আমাকে চড় মেরে দাঁত ফেলে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন, আজ তাকে আমি আমার লেখা বইতে অটোগ্রাফ দিয়েছি। জীবনের অঙ্কের ফলাফল কোনো কোনো সময় ব্যতিক্রম হয়। লেখালেখি আজ আমার আকাশে সাফল্যের সূর্য এনে দিয়েছে। এখন আমার সূর্যদিন। রোজ সকালে আমার আকাশে পূর্ণতার অম্লাণ সূর্য ওঠে। আমার মায়ের গায়ের বিধবা শাড়িতে সেই সূর্যের আলো এসে পড়ে।
আজ এই বইমেলায় আল্পনা করিমকে দেখে পুরনো অতীত মনে হতেই চোখ টলমল করে উঠল। প্রকাশক আমজাদ হোসেন হেসে বললেন, ‘তোমার চোখে পানি! পাঠকের ভালোবাসা তোমাকে আবেগি করেছে, না? হা হা হা। তুমি সফল লেখক।’
আজ আমি হয়তো একজন সফল লেখক। কিন্তু এই সফল লেখকের লম্বা অতীত কতটা কষ্টের ছিল, তা আমজাদ হোসেনেরা জানেন না।
আমজাদ হোসেন বললেন, ‘চোখের পানি মুছে ফেলো। টিভি চ্যানেলের লোকেরা আসছে। তোমার ইন্টারভিউ নেবে।’ আমি চোখ মুছে সামনের দিকে তাকাই। টিভি চ্যানেলের লোকেরা আমার ইন্টারভিউ নিতে ক্যামেরা লাইট রেডি করছে। আমার বই এবং বইমেলা সম্পর্কে দুটো কথা বলতে আমিও রেডি হচ্ছি।
আমিশাপাড়া, নোয়াখালী

 


আরো সংবাদ



premium cement

সকল