২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫
`

আলোহীন এক প্রদীপের গল্প

-

বাজারের প্রতিটি মানুষের কাছে এক নামে পরিচিত বিশ্বের ছেলে প্রদীপ। বাজারের গণ্ডির ভেতরেই এক ছোট্ট পাড়ায় গুটি কয়েক ভদ্র সমাজের বসবাস। এই ভদ্র সমাজেরই এক হতদরিদ্র সদস্যের নাম বিশ্ব। বাজারের মেছো গলিতে ভাঙাচোরা একটা চায়ের দোকান। বিশ্ব বাবুর সংসারের অবস্থা শোচনীয় বলাই ভালো হবে। অভাব অনটনের একদম ভয়ানক পর্যায়ে গেলে একটা মানুষ তথা তার পরিবারের অবস্থা কেমনটা হতে পারে সেটা এই বিশ্বের সংসারের দিকে তাকালেই বোঝা যায়। প্রতিনিয়ত সংসারের একটা না একটা ঝামেলা লেগেই থাকে। যে ঝামেলাগুলোর একমাত্র কারণ অভাব। একটা চায়ের দোকান। সেটাও একদম পজিশনহীন। সকালবেলা বাজারের টাইমে ওই জেলে কিংবা মাছ কিনতে আসা কয়েকজন চা খায়। এখনকার চায়ের দোকান মানেই তো রঙ-বেরঙের টিভি মনিটরের মজমা। বিশ্বের দোকানে টিভি মনিটর তো দূরের কথা বিদ্যুৎ পর্যন্ত নেই। রাতে ল্যাম্প জ্বালিয়ে বসে থাকে দোকানে। বিশ্বের সংসারের অভাব ও সাংসারিক ঝামেলাটা শুধু বাড়িতেই সীমাবদ্ধ নয়, বাজারের দোকানে এসেও মাঝে মাঝে বিশ্ব ও তার স্ত্রীর ঝামেলা হয়। বাজারের অন্যসব দোকানদার অধীর আগ্রহে এগিয়ে আসে বিশ্বের এই ঝামেলার সমাধানে। নানাভাবে মজা লুটে নেয়ার চেষ্টা চালায়। অসহায়ের মতো তাকিয়ে থাকে বিশ্ব। অসহায় এই বিশ্বের ঘরে জন্ম নেয়া ছেলেটার নাম প্রদীপ। বাবার বড় ছেলে প্রদীপ। বয়স ছয় বছর হবে। সারাক্ষণ বাজারের অলিতেগলিতে তার চলাফেলা। বাজারের এমন কোনো দোকানদার নেই যাকে প্রদীপ চেনে না। সকালে ঘুম থেকে বাজারে আসে প্রদীপ বাবু। আর রাতে বাবার দোকান বন্ধ হওয়ার আগ পর্যন্ত পুরা বাজার চষে বেড়ায় ছোট্ট প্রদীপ। এখন প্রদীপ যেখানেই থাকুক না কেন বাজারের বাইরে কোথাও যে যাবে না বা হারাবে না সেটা তার বাবা ও মা দু’জনই বুঝতে পেরেছে। কিন্তু ক’দিন আগেও প্রায়ই দেখতাম প্রদীপের মা হাউমাউ করে কান্নাকাটি করতে করতে প্রদীপকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। এমনও দিন ছিল প্রদীপের মা চার-পাঁচবার হাউমাউ কান্না করতে করতে খুঁজেছে। বাজারের ছোট বড় সব শ্রেণীর মানুষকে প্রদীপ নাম ধরেই ডাকে। প্রদীপের কথাবার্তা ও চাল-চলনে পাকনামো ভাবটা যে কারোরই চোখে পড়বে। একটা বাজার মানেই নানা মানসিকতার মানুষের মিলন মেলা। সবার মানসিকতা এক নয়। কেননা সবাই সব শিশুকে শিশু হিসেবে নিতে পারে না। তাদের কাছে তাদের সন্তানই শিশু। তার ছেলে চটপট করে কথা বললে সেটা হয় ট্যালেন্ট। অন্যের কাছে গর্বভরে সেটার প্রচার করার চেষ্টা করে নানাভাবে যে তার ছোট্ট ছেলে ওটা বলেছে সেটা বলেছে। বেশ চালু। মেধাবীও। অথচ এই ছোট্ট প্রদীপের চটপট ভাবটা তাদের কাছে পাকনামো ছাড়া কিছু নয়। প্রদীপকে নিয়ে নানাভাবে মজা করে। কেউ ডাক দেয় বিড়ি খেতে, কেউ আবার খাবার কিনে দেয়ার লোভ দেখিয়ে কাছে ডেকে প্যান্ট খুলে দেয়। প্রদীপকে নিয়ে লেখার জন্য বেশ কয়েক দিন ধরে প্রদীপকে নিয়ে চলছি। প্রদীপকে প্রথম যেদিন আমি ডাক দিয়েছিলাম, প্রদীপ আমার কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বলছিল, কি বিড়ি খাওয়াবি? সেই জন্য ডেকেছিস? এর মানে প্রদীপকে মানুষ এভাবেই ডেকে বিড়ি খাওয়ায় কিংবা খাওয়ানোর কথা বলে। এরপর প্রদীপের নানা গল্প শুনতে শুরু করলাম। প্রদীপের কথাগুলো অসাধারণ সুন্দর। স্কুলে যাওয়ার কথা বললে প্রদীপ বলে স্কুলে যাবো। যখন বলি বড় হয়ে তুমি কি হবা? তখন প্রদীপ বলে বাবার মতো চা’র দোকান দেবো। সেদিন বিকালে আমরা বাজারের একটা গলিতে বসে রোদ পোহাচ্ছিলাম। এরই মধ্যে প্রদীপ হাজির হলো লাল একটা কলম নিয়ে এবং লক্ষ করলাম প্রদীপ কিছু খুঁজছে। আমি জিজ্ঞেস করলে প্রদীপ বলল, কলম দিয়ে লিখব, তাই কাগজ খুঁজছি। এই বলে সাদা একটা কিছু উঠালো কিন্তু সেটা ছিল টেইলার্সের দোকানের সাদা টুকরো কাপড়। সেটাতেই লেখার চেষ্টা করছে প্রদীপ। সেলিম ভাই একটা কাগজ উঠিয়ে দিলেন। প্রদীপ সেটা নিয়ে বসে কলম দিয়ে আঁকাতে শুরু করল। সেলিম ভাই জিজ্ঞেস করল, প্রদীপ তুমি কি অ আ লিখতে পারো। প্রদীপ বলল, না। আমি ১০০ গ্রাম , ২০০ গ্রাম লিখতে পারি। পরে মিনিট পাঁচেক কলম দিয়ে আঁকিবুঁকি করে আমাদের দেখাল ১০০ গ্রাম। পরে দেখাল ২০০ গ্রাম। আসলে সেটা ছিল শুধু কলম দিয়ে আঁকিবুঁকি। প্রদীপের স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ থাকলেও তার পরিবেশটা তার উল্টো। এই বয়সে প্রদীপের থাকার কথা ছিল স্কুলের আঙিনায়। তবে কেন প্রদীপ বাজারের অলিগলির চাতক পাখি? কে ডেকেছে তাকে বাজারে? কেনইবা সে এমন হলো? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কি শুধুই তার বাবা-মার মধ্যে সীমাবদ্ধ, নাকি মানুষ হিসেবে আমরাও এই উত্তর জানি। প্রদীপকে যারা পাকনামো, ফাজিল, ইঁচড়ে পাকা বলে সম্বোধন করে তারা কি কখনো ভেবেছেন এই প্রদীপকে নিয়ে। আপনার ছেলে-মেয়েরা কী খেয়ে মানুষ হচ্ছে। কী রকম পোশাক পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই একই সময়ে এই প্রদীপ কী খাচ্ছে। কেমন পোশাকে চলছে। ভাবা উচিত নয়কি? প্রদীপের ছেঁড়া পোশাক কি শুধু আমাদের বিনোদনের অংশ, নাকি আমাদেও দায়িত্বহীনতার পরিচায়কও। না জানি এ রকম কত প্রদীপ দরিদ্রতার স্টিমরোলারে পিষে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নষ্ট হওয়া এই প্রদীপের জন্য আমরাও কি দায়ী নই?


আরো সংবাদ



premium cement