১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৬ বৈশাখ ১৪৩১, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫
`

বাঙালির নবান্ন উৎসব

-

ষড়ঋতুর দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। ঋতুবৈচিত্র্যের এ দেশে হাজার বছরের বাঙালিয়ানায় বিভিন্ন সংস্কৃতি ধরা পড়ে ভিন্ন ভিন্ন আয়োজনের মধ্য দিয়ে। আর বাঙালিয়ানার সংস্কৃতি, কৃষ্টিকালচার মিশে আছে এ দেশের মানুষের বিশ্বাস ও মনেপ্রাণে। তাই তো বাঙালি তার নিজস্ব সংস্কৃতি বুকে ধারণ ও লালনপালন করে আসছে সেই প্রাচীনকাল থেকেই।
ঋতুবৈচিত্র্যে হেমন্তের আগমন ঘটে শীতকে সাথে নিয়েই। বাতাসের সাথে হালকা ঠাণ্ডা আর কুয়াশার চাদর বুকে জড়িয়ে হেমন্ত আসে শীতের পরশ মেখে। কার্তিকের শেষে ও অগ্রহায়ণের শুরুতে হয় ধান কাটার মহোৎসব। এ সময় ফসলের ক্ষেত ভরে ওঠে সোনালি ধানের হাসিতে। সেই সাথে কৃষকের মুখেও হাসি ফোটে সোনালি ফসল ঘরে ওঠার আনন্দে।
হেমন্ত এলেই দিগন্তজোড়া ফসলের মাঠ ছেয়ে যায় হলুদ রঙে। এই শোভা দেখে কৃষকের মন নেচে ওঠে নতুন ফসল ঘরে ওঠার আনন্দে। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালির জীবনে অগ্রহায়ণ কৃষকের নতুন বার্তা নিয়ে আসে। নবান্ন হচ্ছে হেমন্তের প্রাণ। নতুন ধানের চাল দিয়ে তৈরি পিঠা, পায়েস, ক্ষীরসহ নানা রকম খাবারে মুখরিত হয়ে ওঠে বাঙালির প্রতিটি ঘর। নতুন ধানের পিঠা-পায়েসের ঘ্রাণে ভরে ওঠে চারপাশ। নতুন ধান ঘরে আসার পর শুরু হয় চালের তৈরি পিঠাপুলি খাওয়ার নবান্ন উৎসব। বাঙালির ঘরে ঘরে নবান্নের হইচই পড়ে যায়। চিরাচরিত এ উৎসব আমাদের সংস্কৃতির শেকড়ের অংশ।
অগ্রহায়ণের নবান্ন নিয়ে আসে খুশির বার্তা। নতুন ধান ঘরে উঠানোর কাজে ব্যস্ত থাকেন কৃষক-কৃষাণীরা। আর ধান ঘরে উঠলে পিঠা-পায়েস খাওয়ার ধুম পড়ে যায়। পাড়ায় পাড়ায় চলে নবান্ন উৎসব। গ্রামবাংলায় নতুন এক আবহ সৃষ্টি হয়। নবান্ন উৎসবের সাথে মিশে আছে বাঙালিয়ানার হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য আর সং¯ৃ‹তির নানা দিক। প্রাচীনকাল থেকেই বাঙালি জাতি ধর্ম-বর্ণ উপেক্ষা করে নবান্নকে কেন্দ্র করে উৎসবে মেতে ওঠে। একে অন্যের মধ্যে তৈরি হয় সামাজিক মেলবন্ধন।
নতুন ধান ওঠার খুশিতে গ্রামবাংলায় চলে নানা উৎসব-আয়োজন। নতুন ধান কাটা আর সেই সাথে প্রথম ধানের অন্ন খাওয়াকে কেন্দ্র করে পালিত হয় এই উৎসব। বাঙালির বারো মাসে তেরো পার্বণÑ এ যেন সত্যিই হৃদয়ের বন্ধনকে আরো গাঢ় করার উৎসব। সোনালি ধানের প্রাচুর্য আর বাঙালির বিশেষ অংশ নবান্নকে ঘিরে অনেক কবি-সাহিত্যিকের ভাবনায় ফুটে উঠেছে প্রকৃতির চিত্র। কবি জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় লিখেছেনÑ ‘আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়/ মানুষ নয়Ñ হয়তো বা শঙ্খচিল শালিখের বেশে/ হয়তো ভোরের কাক হয়ে এই কার্তিকের নবান্নের দেশে/ কুয়াশার বুকে ভেসে একদিন আসিব এ কাঁঠাল ছায়ায়।’ কবির কবিতার লাইনের মতোই নবান্নে ধরা পড়ে চিরায়ত বাংলার রূপ।
অগ্রহায়ণ এলেই কৃষকের মাঠজুড়ে ধান কাটার ধুম পড়ে যায়। অত্যন্ত ব্যস্ত সময় কাটে এ দেশের কৃষক-কৃষাণীদের। ধান ভানার গান ভেসে বেড়ায় বাতাসে। ঢেঁকির তালে মুখরিত হয় বাড়ির আঙিনা। অবশ্য যান্ত্রিকতার ছোঁয়ায় এখন আর ঢেঁকিতে ধান ভানার শব্দ খুব একটা দেখা যায় না। তবে সেদিনের স্মৃতি খুব সহজেই ভেসে ওঠে মনের আঙিনায়Ñ এক সময় ঢেঁকিছাঁটা চাল দিয়েই ভাতের জোগাড় হতো। তারপরও নতুন চালের ভাত নানা ব্যঞ্জনে মুখে দেয়া হয় আনন্দঘন পরিবেশে। নতুন চাল দিয়ে তৈরি হতো নানা রকম পিঠাপুলি, ক্ষীর-পায়েস। দেশের কোনো কোনো অঞ্চলে এখনো নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে চলে খাওয়া-দাওয়ার ধুম। নবান্ন আর পিঠাপুলির উৎসবে আনন্দে মাতোয়ারা হয় সবাই। তাই অগ্রহায়ণ এলেই সর্বত্র বেজে ওঠে নতুন ধ্বনি। যেহেতু নবান্ন একটি ঋতুকেন্দ্রিক উৎসব, তাই বছরঘুরে ফিরে আসে নবান্ন। হেমন্তে নতুন ফসল ঘরে তোলার সময় এই উৎসব পালন করা হয়। হাজার বছরের পুরনো এ উৎসবটি যুগ যুগ ধরে একইভাবে পালন হয়ে আসছে। নবান্ন উৎসবে গ্রামগঞ্জে আয়োজন করা হয় গ্রামীণমেলার। এসব মেলায় শিশু-কিশোর থেকে শুরু করে সব শ্রেণী-পেশার মানুষের ঢল নামে। উৎফুল্ল দেখা যায় ছোট-বড় সব বয়সের মানুষকে। গ্রামের খেটে খাওয়া মানুষ এ উৎসব ভিন্নভাবে পালন করে। মেলার এককোণে রাতভর চলে গানের উৎসব। এই উৎসবে উপস্থিত থাকেন নবীন-প্রবীণ সবাই। বাহারি সব খাবারের দোকানের পসরা সাজিয়ে বসানো হয় গ্রামীণমেলা। তবে গ্রামীণমেলা এখন আর শুধু গ্রামেই হয় না, শহরের মানুষেরাও এখন নবান্ন উৎসব পালন করে থাকেন।
কয়েক বছর ধরে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ বেশ ঘটা করেই পালন করে আসছে নবান্ন উৎসব। বর্ণিল আয়োজনের মধ্য দিয়ে তিন দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠান রাজধানীবাসী উপভোগ করে থাকেন। নানা রকম পিঠাপুলির আয়োজন থাকে নবান্ন উৎসবে। আমাদের দেশে নবান্ন উৎসবে অঞ্চলভেদে আয়োজন করা হয়ে থাকে জারি, সারি, মুর্শিদী, লালন, পালা ও বিচারগান। আর মেলায় পাওয়া যায় নানা স্বাদের খাবার। ছোটদের বাড়তি আনন্দ দিতে মেলায় আসে নাগরদোলা, পুতুলনাচ, সার্কাস, বায়োস্কোপসহ জানা-অজানা আরো অনেক আয়োজন। নবান্ন বাঙালির প্রাণের উৎসব, এতে কোনো সন্দেহ নেই। তাই এ উৎসব চিরস্থায়ী হোক এ দেশে, এটাই প্রত্যাশা আমাদের।


আরো সংবাদ



premium cement