২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ১৮ রমজান ১৪৪৫
`

মানবতা

জীবনের বাঁকে বাঁকে
-


মাগরিবের নামাজ শেষ। মসজিদ থেকে বের হচ্ছেন মুসল্লিরা। মাগরিবের ওয়াক্তে মুসল্লিদের ভেতরে তাড়াহুড়া কাজ করে বেশি। কেননা বেশির ভাগ মুসল্লি বাজারের দোকানদার।
মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছেন এক যুবক। এক হাত বুকের সাথে চেপে রাখা আরেক হাতে রুমাল। রুমাল দিয়ে চোখের পানি মুছছেন অনবরত। চোখে-মুখে তার অসহায়তার ছাপ। আমি মসজিদ থেকে বের হতেই নজর পড়ল ওই যুবকের ওপর। কিছু যেন বলতে চাচ্ছেন তিনি। বেশ কয়েকজন মুসল্লি চলে গেছেন তাকে ওভারটেক করে, এমন সময় আমি গিয়ে দাঁড়ালাম তার পাশে। কিছু জিজ্ঞেস করব ভাবছি, এমন সময় হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি। মাটির দিকে তাকিয়ে হাত বাড়াচ্ছেন কিছু সাহায্যের জন্য। তার কান্নার আওয়াজে নিস্তব্ধ জায়গাটা। মুসল্লিরা এগিয়ে এলেন। আমি জানতে চাইলাম ঘটনাটা। জানতে চাইলেন আরো কেউ কেউ। তিনি কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানালেনÑ দেশের বাড়ি কিশোরগঞ্জ। ব্যবসা করতে এসেছিলেন আমাদের পাশের জেলা নড়াইলে। বিছানার চাদর, বালিশের কাভার, জায়নামাজ, জামদানি শাড়িসহ আরো অনেক জিনিস বিক্রি করে বেড়ান। গত রাতে বিক্রি শেষে ফেরার সময় ফাঁকা জায়গা থেকে তিনজন মোটরসাইকেল আরোহী দুর্বৃত্ত ১৮ হাজার টাকাসহ সব কাপড়চোপড় ছিনিয়ে নিয়ে গেছে। তিনি বলছিলেনÑ ‘ভাই, ওরা বিকেলে আমাকে ফলো করছিল। আমি কিছুটা বুঝতে পেরেছিলাম। আবার ভাবলাম বেশ কয়েক বছর ধরেই এই এলাকায় ব্যবসা করছি, কিন্তু খারাপ কিছু হয়নি। তাই তো আরেক মন বলছিল, মনে হয় আমার ভাবনায় ভুল হচ্ছে। তা ছাড়া, আমার মাল বিক্রি করাও খুব জরুরি ছিল ভাই। আমার বোনের বিয়ে সামনের সপ্তাহে। ভেবেছিলাম মালগুলো যত তাড়াতাড়ি বিক্রি করতে পারব, তত আগে বাড়ি ফিরতে পারব। আর বাড়ি ফিরব বলেই নগদ টাকাগুলোও বাড়ি পাঠাইনি ভাই। ভেবেছিলাম একবারে পাঠিয়ে ভাড়ার টাকা রেখে রওনা হবো বাড়ি। কিন্তু ভাই, মনের ভাবনা মনেই রয়ে গেল। ওদের হাতে-পায়ে ধরেছিলাম ভাই। ওরা আমাকে মারছিল। অনেক ধস্তাধস্তি করেও আমার সাথে পারছিল না। অবশেষে আমার ডান হাত ধরে মোচড় মেরে আমার ডান হাতটা ভেঙে সব কিছু নিয়ে যায়। ভাঙা হাত নিয়ে কাছের একটা বাজারে গিয়ে এক দোকানে জানালাম। সেই দোকানদার আমার হাতের অবস্থা দেখে মায়া করে একটা মোটরসাইকেল ভাড়া করে সেই রাতেই পাঠালেন নড়াইল সদর হাসপাতালে। ডাক্তার দেখে একটা ইনজেকশন দিয়ে বললেন, হাতে অপারেশন করতে হবে। তা না হলে ব্যান্ডেজ করা যাবে না। পরে হাসপাতাল থেকে বের হয়ে একটা মসজিদে শুয়ে সারা রাত কেঁদেছি। সকালে আবার বাসে করে সেই বাজারে এসে কয়েকজনকে বললাম ঘটনাটা। তারা আমার কথায় কান দিলেন না এবং কেউ কেউ বললেন, আমি নাকি মিথ্যা বলছি। চিটার-বাটপারি ফন্দি আঁটছি। অবশেষে নিরুপায় হয়ে বাসে উঠেছিলাম মাগুরা যাওয়ার জন্য। ভাড়া না থাকায় ওরা আমাকে এই বাজারে নামিয়ে দিয়েছে। সারা দিন বাজারের ওই সিঁড়িওয়ালা ঘাটে বসে কেঁদেছি। আর ভেবেছি, বাড়ি যাওয়ার জন্যও তো টাকার দরকার, সেই টাকা কোথায় পাবো। অবশেষে সন্ধ্যায় ভাবলাম আল্লাহর ঘরে যাই। আল্লাহ হয়তো একটা ব্যবস্থা করেই দেবেন। ভাই, এই হাত দিয়ে কত টাকা মানুষকে দান করেছি। সেই হাত আজ সামান্য কয়টা টাকার জন্য মানুষের কাছে পাতছি। মসজিদের সামনে থেকে বেশ কয়েক টাকা উঠল। কিন্তু এখান থেকে কিশোরগঞ্জের ভাড়া হাজারের ওপরে। চিন্তা করলাম বাজার থেকে কিছু টাকা উঠিয়ে দিলে হয়তো ছেলেটার উপকার হতো। বিবেকের তাড়নায় জীবনে প্রথমবারের মতো আমি বাজারের দোকানদারদের কাছে গিয়ে হাত পাততে শুরু করলাম। এক দোকানদার একদম জেরা করতে শুরু করলেন। আসল-নকল যাচাই করতে প্রতিটি দোকানদার যেন কষ্টিপাথরস্বরূপ। একজন মানুষ হয়ে আরেক মানুষকে সাহায্য করতে যে এতটা যাচাই-বাছাইয়ের প্রশ্ন উঠতে পারেÑ ভাবা মুশকিল ছিল সেদিনের পর থেকে। কয়েক দোকানে গিয়ে এত সময় অপচয় হলো, সেটা বলার মতো নয়। আর আধা ঘণ্টা জেরা করে শেষে হাতে দেয় ১০ টাকা, তাও আবার পাঁচ টাকা ফেরত চায়। অদ্ভুত সব মানুষের সান্নিধ্য পেতে লাগলাম।
ভাবলাম এভাবে সম্ভব নয়। বাজারের সভাপতির কাছে গেলাম। একটা সান্ত্বনাদায়ক উক্তিও দিতে পারলেন না তিনি। পাঠালেন সহসভাপতির কাছে। তিনি কিছুটা দরদী হলেও ব্যস্ততায় পারলেন না সমাধান দিতে। এরপর আমি বেশ কয়েকজনকে ফোন দিলাম। বাজারে তাদের অবস্থান জেনে গিয়ে হাজির হলাম তাদের কাছে। আরাফাত, ইমরান ভাই যথাসাধ্য সাহায্য করলেন। এরপর গেলাম রোকন ভাইয়ের কাছে। রোকন ভাই তাকে সৈয়দ কাকার হোটেলে নিয়ে খাওয়ালেন। এরপর রোকন ভাইয়ের দোকানে তাকে বসিয়ে বেশ কয়েক টাকা তুললাম স্ট্যান্ড থেকে। টাকা গুনতে বললাম এক ছেলেকে। গুনে জানালÑ ভাই এক হাজার ১০০ টাকার মতো হয়েছে। এর মধ্যে ঘটে গেল এক অমানবিক ঘটনা। কোথা থেকে এক লোক কোনো কথাবার্তা ছাড়াই ওই যুবকের ভাঙা হাত ধরে বুকে পা বাঁধিয়ে টানাহেঁচড়া শুরু করলেন। আর অকথ্য গালিগালাজ দিয়ে বলতে লাগলেন, শালা ভাঁওতাবাজি কোথায় শিখেছিস? আর ওই যুবক হাউমাউ করে কান্না করতে লাগলেন। রোকন ভাই বিষয়টি সামলালেন। এরপর তিনি উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আপনি আমার ধর্মের ভাই। আপনি আমার জন্য কত কথা শুনছেন। ভাই, আমার জন্য আপনি যা করেছেন সারাজীবন মনে থাকবে। আপনি আমাকে গাড়িতে উঠিয়ে দেন। এরপর আমার নাম্বার কাগজে লিখে দিতে বললেন। দিলাম। এরপর গাড়িতে ওঠার আগে ছেলেটা ওইখানের সবাইকে কেঁদে কেঁদে বললেন, ভাই আপনারা আমার জন্য অনেক করেছেন। আমি মরে গেলেও আপনাদের ঋণ শোধ করতে পারব না। ভাই আমিও কোনো মায়ের সন্তান। কোনো বোনের ভাই। কোনো ভাইয়ের ভাই। আমি যদি মিথ্যা বলে এই টাকাটা আপনাদের কাছ থেকে নিয়ে থাকি, তাহলে কিয়ামতের মাঠে আমার গায়ের গোশত কেটে নিয়েন ভাই। এরপর গাড়ি এলো। তিনি আবার আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বললেন, আপনার কথা আমার সারা জীবন মনে থাকবে। আমি বাড়ি পৌঁছতে পারলে আপনাকে ফোন দেবো। তিনি হয়তো বাড়ি পৌঁছেছিলেন; কিন্তু নাম্বার হয়তো হারিয়ে গিয়েছিল তার কাছ থেকে। তার জীবনে ঘটে যাওয়া বিপদটা শুধু তাকেই শিক্ষা দেয়নি; শিক্ষা দিয়েছে আমাকেও। আমি অনেক মানুষ চিনতে পেরেছিলাম সেদিন সন্ধ্যায়। আর্তমানবতার বুলি ছোড়া মানুষের ভেতরকার রূপ দেখতে পেরেছিলাম সেদিন। আল্লাহ যেন এমন পরিস্থিতিতে কাউকে না ফেলেন।

 


আরো সংবাদ



premium cement